অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণতা কি মানসিক রোগ
-অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক আলম
ঘটনা-০১
অফিস থেকে ফিরে কাপড় পাল্টানোর অবকাশটুকু পায় না শোভন। শায়লা এসে হাত থেকে মুঠোফোনটা নিয়ে নেয়। তারপর ঘাঁটতে থাকে দ্রুত। কল-লিস্ট, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে সরু চোখে তাকায় শোভনের দিকে। চোখজুড়ে রাজ্যের সন্দেহ। শোভনের খুব অসহায় লাগে। নিজের স্ত্রীর কাছে সার্বক্ষণিক সন্দেহের শিকার হতে হতে আজকাল দমবন্ধ হয়ে আসে ওর। কিছু বলতেও ইচ্ছে করে না। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কেবল প্রবল ঘৃণাই বের হয়ে আসে।
ঘটনা-০২
তৃতীয় বছরে পা রাখল ফাহিম আর মৌরীর সংসারজীবন। এ উপলক্ষ্যে ছোটোখাটো পার্টির আয়োজন করেছিল। পার্টিতে এসেছিল মেহেদি। মৌরীর পুরোনো বন্ধু। মেহেদিকে দেখেই ফাহিমের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ওর বদ্ধমূল ধারণা, বিয়ের আগে মেহেদির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মৌরীর। সেই সম্পর্ক এখনো আছে। পার্টি শেষে এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। একপর্যায়ে চড় বসিয়ে দিয়েছিল মৌরীর গালে। সকালে মৌরী বাবার বাসায় চলে যায়।
ঘটনা-০৩
পাপড়ি রহমানের বয়স ৪৫ বছর। ছেলে অপু এবারই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। ছেলেকে সব সময়ই সন্দেহ করতেন। ইদানীং সেটা বেড়ে গেছে খুব। পাপড়ি রহমানের ঘুম আসে না। রাতে ছেলের ঘরের সামনে দিয়ে হাঁটাঁহাঁটি করেন। সারা জীবন নিজের স্বামীকে সন্দেহ করেছেন। এখন সেটা স্থানান্তরিত হয়ে ভর করেছে সন্তানের ওপর।
ওপরের তিনটি ঘটনার সবকটির কেন্দ্রেই মূল জটিলতা হিসেবে রয়েছে ‘সন্দেহ’। এসব সন্দেহ যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু ‘সন্দেহ’ ব্যাপারটি যে কোনোভাবেই ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনে না, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। বরং জীবনকে করে তোলে বিভীষিকাময়।
ঝগড়া নয়,
শান্তভাবে কথা
বলুন তার সঙ্গে।
সন্দেহপ্রবণতার লক্ষণ
- সঙ্গী বা সঙ্গিনী কোথায় আছে, কী করছে, সঙ্গে কে আছে প্রভৃতি প্রশ্ন করে সারা দিনের কার্যকলাপ সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাওয়া।
- বিনা অনুমতিতে, কখনো বা জোর করে মোবাইল, ই-মেইল, ওয়েবসাইটের হিস্টোরি ইত্যাদি ঘাঁটাঘাঁটি করা।
- যেকোনো ফোন নম্বর থেকে কল এলে জবাবদিহির মুখোমুখি করা।
- সঙ্গী বা সঙ্গিনী অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত, সর্বক্ষণ এ রকম সন্দেহ করা।
- ঠুনকো অজুহাত বা কোনো প্রমাণ ছাড়াই পার্টনারকে অভিযুক্ত করা ও অপমান করা।
- কথায় কথায় আত্মহত্যা, চলে যাওয়া, নিজের ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া।
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক ধরনের ঘোষিত বা অঘোষিত বিধিনিষেধ আরোপ করা।
- নিজের সামনে পার্টনারকে বিপরীত লিঙ্গের কেউ প্রশংসা করলে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠা।
- লুকিয়ে লুকিয়ে পার্টনারের গতিবিধি অনুসরণ করা।
- এই বুঝি প্রিয় মানুষটি আমাকে রেখে চলে গেল; সব সময় এমন ভয়ে থাকা।
এটি কি কোনো রোগ
সবার ক্ষেত্রে হয়তো একরকম নয়। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এই অতিরিক্ত, অহেতুক, অযৌক্তিক সন্দেহ কোনো মানসিক রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাধারণত সিজোফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের জন্য এ রকম হয়ে থাকে। শৈশবের কোনো মানসিক আঘাতের ফলে বা বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া যথাযথ না হলে এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন- বাবা-মা ছাড়া বড়ো হওয়া, ছোটোবেলায় বাবা-মার মৃত্যু বা ধর্ষণের শিকার হওয়ার মতো ঘটনা কোনো শিশুকে সারা জীবনের জন্য অসুস্থ বানিয়ে দিতে পারে। আবার প্রিয় মানুষের প্রতারণা, দুর্ব্যবহারও হয়ে উঠতে পারে এর কারণ।
কী করবেন
সঙ্গী বা সঙ্গিনীর এমন আচরণকে হেলাফেলাভাবে নেবেন না। তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করুন। তেমন মনে হলে, মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিশ্চিত হোন, সত্যিই আপনার পার্টনার কোনো সাইকোটিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত কি না। যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করুন।
প্রতিকার-প্রতিরোধ
- ঝগড়া নয়, চিৎকার-চেচাঁমেচি নয়, শান্তভাবে কথা বলুন তার সঙ্গে। খোলামেলাভাবে সব বুঝিয়ে বলুন। আপনার এবং তার দুজনের অবস্থান দুজনের কাছে পরিষ্কার করে দিন।
- পার্টনার যেমনই হোন, তাকে দূরে ঠেলে দেবেন না। সরিয়ে দেওয়া সমাধান নয়। মনে রাখবেন, যা কিছুই হোক তিনি কিন্তু আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।
- প্রতিশোধপরায়ণ হবেন না। জেদের বশে এমন কিছু করবেন না, যা তার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- নিজের ভুল স্বীকার করে নিন। আপনাকে ভুলভাবে সন্দেহ করা হলে নিজেকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন, তিনি আপনার ব্যাখ্যা বা প্রমাণ গ্রহণ করার মতো অবস্থায় নেই।
- নিজের ভুল স্বীকার করে নিন। আপনাকে ভুলভাবে সন্দেহ করা হলে নিজেকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন, তিনি আপনার ব্যাখ্যা বা প্রমাণ গ্রহণ করার মতো অবস্থায় নেই।
অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক আলম
এমবিবিএস, এফসিপিএস, হু-ফেলো (চাইল্ড সাইকিয়াট্রি)
চাইল্ড, কিশোর অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগ
পরিচালক (অব.), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা।
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিক), ঢাকা।