অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ, জটিলতা ও চিকিৎসা

অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ, জটিলতা ও চিকিৎসা

অধ্যাপক ডা. কোররাতে আইনুল ফরহাদ (রোডিয়া)

পিরিয়ড বা মাসিক একজন নারীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাভাবিক বিষয়। পিরিয়ডের মাধ্যমেই একজন নারী সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা লাভ করেন। সাধারণত, ৯ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে একজন মেয়ের প্রথম পিরিয়ড শুরু হয় এবং প্রতি মাসে এটা নিয়মিত চলতে থাকে। কিন্তু, শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের তারতম্য ও নানা শারীরিক জটিলতার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। অনিয়মিত পিরিয়ড নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও স্বাভাবিক সুস্থতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

অনিয়মিত পিরিয়ড কী

পিরিয়ড সাধারণত ২৮ দিন পরপর হয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থার তারতম্যের জন্য সব সময় একদম ২৮ দিন পরপর পিরিয়ড না-ও হতে পারে, কয়েক দিন আগে বা পরে হতে পারে, যা খুবই স্বাভাবিক। এক পিরিয়ড থেকে আরেক পিরিয়ড শুরু হওয়ার ব্যবধান সর্বনিম্ন ২১ ও সর্বোচ্চ ৩৫ দিন হতে পারে। কিন্তু কারো যদি ২১ দিনের আগে এবং ৩৫ দিনের পরে পিরিয়ড হয়, তাহলে সেটা হবে অনিয়মিত পিরিয়ড। পিরিয়ড অনিয়মিত হলে তলপেটে তীব্র ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তপাত বা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম রক্তপাত, কখনো পরপর ২ বা ৩ মাস পিরিয়ড বন্ধ থাকার পর একটানা অনেকদিন পিরিয়ড চলা— এমন নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

অনিয়মিত পিরিয়ড কেন হয়

বয়ঃসন্ধিকালে অর্থাৎ পিরিয়ড শুরু হওয়ার প্রথম দিকে একজন নারীর অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে। ঠিক একইভাবে, মেনোপজ শুরু হওয়ার আগে অনিয়মিত পিরিয়ড হয়। আবার যেসব নারী বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান তাঁদের পিরিয়ড বন্ধ থাকে বা অনিয়মিত পিরিয়ড হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণেও এই সমস্যা হয়। যেমন—

অতিরিক্ত মানসিক চাপ : মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তায় থাকলে প্রজনন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে অনিয়মিত পিরিয়ড হয়।

ওজন কম বা বেশি : ওজন অতিরিক্ত কম বা বেশি হলে পিরিয়ডের ওপর প্রভাব পড়ে। ওজন অনেক বেশি হলে নারীদের ডিম্বাশয়ের চারপাশে চর্বি জমে ডিম্বাণু তৈরিতে সমস্যা হয়। যার ফলে পিরিয়ড নিয়মিত হয় না। আবার ওজন খুব কম হলেও পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে।

অতিরিক্ত ব্যায়াম : অতিরিক্ত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করলে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যায়। ফলে অনিয়মিত পিরিয়ড হয়।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম : মেয়েদের হরমোনজনিত একটি রোগ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা পিসিওএস। এ রোগ হলে ডিম্বাশয়ের চারপাশে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়। ফলে, ডিম্বাণু তৈরি হওয়ার পরও ডিম্বাশয়ের বাইরে বের হতে পারে না। এর ফলে, ৩ বা ৪ মাস পরপর পিরিয়ড হয়; অনেক সময় হয়ই না। আবার পিরিয়ড হলে খুব বেশি রক্তপাত হয় এবং অনেক দিন থাকে।

থাইরয়েড : কোনো নারীর থাইরয়েড হরমোনজনিত সমস্যা হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজম থাকলে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়।

জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ : জন্মনিয়ন্ত্রক বিভিন্ন ওষুধ ও ইনজেকশন অনিয়মিত ব্যবহার করলে বা ব্যবহার করা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে।

এন্ডোমেট্রিয়াল সিস্ট বা চকলেট সিস্ট : এন্ডোমেট্রিয়াল সিস্ট বা চকলেট সিস্ট হলে জরায়ুর বাইরের এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুলো ছিঁড়ে যায়। যার ফলে অতিরিক্ত রক্তপাত ও ঘন ঘন পিরিয়ড হয়। পিরিয়ডের সময় তলপেটে তীব্র ব্যথা হয়।

জরায়ু টিউমার : জরায়ুতে টিউমার হলে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে পিরিয়ড চলতে পারে। পেটে তীব্র ব্যথা ও অতিরিক্ত রক্তপাত হয়।

অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে নানা রোগের কারণ

গর্ভধারণে সমস্যা : পিরিয়ড নিয়মিত না হলে ডিম্বাশয়ে ডিম নিষিক্ত হওয়ার সঠিক সময় নির্ধারণ করা যায় না। ফলে, গর্ভধারণে সমস্যা হয়। অনেক সময় অপরিকল্পিত গর্ভধারণ হয়, যা মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণে গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা যেমন— প্রিক্ল্যাম্পসিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, প্রসবকালীন অধিক রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

হৃদ্‌রোগ : পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার অন্যতম কারণ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। এ রোগে আক্রান্ত হলে ওজন সহজে কমে না। ফলে, ধীরে ধীরে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়, যা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।

ডায়াবেটিস : যেসব নারীর নিয়মিত পিরিয়ড হয় না, তাঁদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে।

মানসিক বিষণ্নতা : পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার অন্যতম কারণ শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়া। এ হরমোন কমে যাওয়ার প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও পড়ে। মানসিক উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বৃদ্ধি পায়। মেজাজ খিটখিটে থাকে, কোনো কাজে মন বসে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে।

অনিয়মিত পিরিয়ডের চিকিৎসা

অনিয়মিত পিরিয়ড কেন হচ্ছে, সেই কারণ অনুযায়ী এ রোগের চিকিৎসা করা হয়। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা জরায়ুমুখে কোনো পলিপ হওয়ার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হচ্ছে কি না, তা শনাক্তের জন্য জরায়ুর আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়। পিসিওএস থাকলে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন বৃদ্ধির ওষুধ দেওয়া হয়। চকলেট সিস্টের কোনো লক্ষণ থাকলে এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসির মাধ্যমে তা শনাক্ত করা হয়। সিস্ট বেশি বড় হয়ে গেলে এবং ওষুধের মাধ্যমে না কমলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে থাকলে হরমোন থেরাপি বা অ্যান্টি থাইরয়েড ড্রাগস দেওয়া হয়।

প্রতিরোধে করণীয়

অনিয়মিত পিরিয়ডের ঝুঁকি এড়াতে—

  • প্রতিদিন পরিমিত ব্যায়াম করুন ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • পুষ্টিকর খাবার খান।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন ও যথাসম্ভব মানসিক দুশ্চিন্তামুক্ত থাকুন।
  • ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করুন।
  • জন্মনিরোধক ওষুধ সেবনে সচেতন হোন।

অধ্যাপক ডা. কোররাতে আইনুল ফরহাদ (রোডিয়া)

অধ্যাপক ডা. কোররাতে আইনুল ফরহাদ (রোডিয়া)

এমবিবিএস, এফসিপিএস (অবস্‌ অ্যান্ড গাইনি)
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ,
ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিকস, গুলশান

LinkedIn
Share
WhatsApp