প্রযুক্তির আশীর্বাদপুষ্ট এই সময়ে জীবনের অগ্রগতি যেমন বেড়েছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অসুবিধাও। ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করতে করতে আমরা ভুলে যাই, শরীর কোনো যন্ত্র নয়। দিনের পর দিন অনিয়ম, কাজের চাপে শরীরের সহ্যক্ষমতা অতিক্রম হওয়ার বিষয়টি একসময় প্রকাশ পায় বিভিন্ন রোগের মাধ্যমে। এমনই একটি রোগ অস্টিওপোরোসিস। এটি ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত একটি রোগ, যাতে শরীরের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণত যেসব বয়স্ক পুরুষ বহুদিন যাবৎ স্টেরোয়েড ওষুধ সেবন করেন তাদের এবং মহিলাদের মনোপজের পর এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অস্টিওপোরোসিস কেন হয়
অস্টিওপোরোসিস বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সাধারণত দেহে খনিজ লবণ ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতির কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। আমাদের শরীর সবসময় পুরনো বা ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু সরিয়ে নতুন টিস্যু তৈরির মাধ্যমে শরীরের কাঠামো ঠিক রাখে। ৪০ বছর বয়সের পর থেকে শরীরে টিস্যু তৈরির পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুর জায়গা ভরাট না হওয়ায় শরীরের হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং ক্ষয় হতে থাকে। একসময় অল্প আঘাতেই ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়, যাকে অস্টিওপোরোসিস বলা হয়।
কাদের ঝুঁকি বেশি
অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি মহিলাদের বেশি। তবে পুরুষরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকিতে আছেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা নিম্নরূপ-
- মনোপজ শুরু হয়েছে এমন মহিলা।
- দিনের বেশিরভাগ সময় আবদ্ধ ঘরের ভেতরে অবস্থান করেন যারা।
- শরীরচর্চা, কায়িক শ্রম করেন না বা অলস জীবনযাপন করেন এমন ব্যক্তি।
- মদ্যপান ও ধূমপান করেন এমন ব্যক্তি।
- পরিবারের কারো, বিশেষ করে মায়ের এ রোগ থাকলে সন্তানও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
- স্টেরোয়েড সেবনকারী পুরুষ।
অস্টিওপোরোসিসের লক্ষণ
অস্টিওপোরোসিসের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ-
- হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং ঘনত্ব কমে যায়।
- পেশির শক্তি কমে যায়।
- পিঠের নিচের দিকে ব্যথা অনুভ‚ত হয়।
- অস্থিতে ব্যথা হয়।
- মেরুদন্ডের হাড়ের গঠনগত ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়।
- শরীরের উচ্চতা কমে যায়।
অস্টিওপোরোসিস শনাক্তকরণ
হাড়ের এক্স-রের মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস ধারণা করা গেলেও সঠিক পরিমাণ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। হাড় ভাঙ্গার আগেই সঠিক সময়ে অস্টিওপোরোসিস শনাক্ত করার জন্য বোনমিনারেল ডেনসিটি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। সাধারণত কোমর, মেরুদÐের ডিএক্সএ, সেক্সা স্ক্যানের মাধ্যমে হাড়ের ঘনত্ব নিরূপণ করা হয়। তা থেকে হাড় ভাঙ্গার ঝুঁকি নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ করা যায়। এছাড়া রক্তের কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে (বোনটার্ন ওভারমার্কার) অস্টিওপোরোসিসজনিত হাড় ভাঙ্গার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
অস্টিওপোরোসিসের চিকিৎসা
অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনধারায় পরিবর্তন আনা অবশ্যক। এ রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
- ক্যালসিয়াম: যেহেতু অস্টিওপোরোসিস ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত রোগ, তাই এ রোগ প্রতিরোধে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। ক্যালসিয়ামের দৈনিক চাহিদা বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন গড়ে তিন বছর পর্যন্ত প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম, চার থেকে আট বছর পর্যন্ত ৮০০ মিলিগ্রাম, নয় থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত ১৩০০ মিলিগ্রাম, উনিশ থেকে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত ১০০০ মিলিগ্রাম এবং একান্ন বছর বা তদূর্ধ্বে ২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খাবার থেকে গ্রহণ করা উচিত। দুধ ছাড়াও বাদাম, শাকসবজি, হাড়সহ ছোটো মাছে প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে।
- ভিটামিন ডি: সূর্যের আলো হচ্ছে ভিটামিন ডি-র উৎকৃষ্ট উৎস। এছাড়া বিভিন্ন মাছ হতে প্রাপ্ত তেল এবং ডিমের কুসুমেও কিছু পরিমাণ ভিটামিন ডি রয়েছে। অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে ভিটামিন ডি-র ভ‚মিকা অনন্য।
- ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমেও হাড়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব। ব্যায়াম শুরু করার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। তবে যত তাড়াতাড়ি এ অভ্যেস গড়ে তোলা যায় ততই এর উপকারিতা বেশি। অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে ভারোত্তোলন-জাতীয় ব্যায়ামগুলো বেশি উপযোগী।
- জীবনযাত্রায় পরিবর্তন: অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যেস থাকলে তা পরিহার করতে হবে।
সঠিক জীবনযাত্রার সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ল্যাবক্যাল-ডি গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক পুরুষ ও নারী এবং মনোপজ-পরবর্তী নারীদের ক্ষেত্রে অস্টিওপোরোসিসজনিত হাড়ভাঙ্গা প্রতিরোধে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের ভ‚মিকা অপরিসীম। এছাড়া এর চিকিৎসায় বিসফসফোনেট, ইবানড্রোনিক এসিড, জোলেনড্রোনিক এসিডজাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হয়। যা শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করতে পারেন।
৪০ বছর বয়সের পর থেকে শরীরে টিস্যু তৈরির পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুর জায়গা ভরাট না হওয়ায় শরীরের হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং ক্ষয় হতে থাকে।
——————————————————————————————————————————————————
ডা. কাজী শহীদ-উল আলম
এমবিবিএস (ডিএমসি), বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমএস (অর্থো), ডিএমসি
ফেলো পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জারি, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া
সহকারী অধ্যাপক, পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল