আর্থ্রাইটিস ও শীতের আগে আর্থ্রাইটিসের প্রস্তুতি

আর্থ্রাইটিস ও শীতের আগে আর্থ্রাইটিসের প্রস্তুতি

আর্থ্রাইটিস বা বাতব্যথা অত্যন্ত পরিচিত একটি রোগ, যা এক বা একাধিক জয়েন্টকে আক্রান্ত করে ফেলে। এটি মূলত অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের প্রদাহ। পায়ের পাতা, কোমরের জয়েন্ট, হাত এমনকি মেরুদণ্ডেও হতে পারে এই ব্যথা। সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা ও পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ বয়সজনিত আর্থ্রাইটিসের ব্যথায় বেশি ভুগে থাকেন। এছাড়া বংশগত কারণেও আর্থ্রাইটিস হতে পারে।

গরমে আর্থ্রাইটিসের ব্যথার তীব্রতা কিছুটা কম থাকলেও শীতকালে অসহনীয় হয়ে ওঠে। এ সময় বয়স্ক লোকজন এবং যারা আর্থ্রাইটিস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো জটিল রোগে ভুগছেন তাঁদের কষ্ট বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই শীত আসার আগেই নিতে হবে সুস্থ থাকার প্রস্তুতি।

আর্থ্রাইটিসের রকমফের

আর্থ্রাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ ও পরিচিত ধরন হলো অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস। দৈনন্দিন জীবনে অতিরিক্ত কাজ করার কারণে হাড়ের জয়েন্টে অতিরিক্ত চাপ পড়ে যে ব্যথার সৃষ্টি হয় সেটাকে অস্টিওআর্থ্রাইটিস বলে। মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম অনেক সময় ভুলক্রমে জয়েন্ট সেলকে আক্রমণ করে বসে। এ কারণে জয়েন্টে প্রদাহ তৈরি হয়, যা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস নামে পরিচিত। আবার, রক্তের মাধ্যমে জীবাণু হাড়ের জয়েন্টে গিয়ে প্রদাহের সূচনা করার ফলে যে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয় তাকে সেপটিক আর্থ্রাইটিস বলে। অন্যদিকে, জয়েন্টে ইউরিক অ্যাসিড জমা হলে অথবা ক্যালসিয়াম পাইরুফসফেট জমা হলে গাউট নামে আরেক ধরনের আর্থ্রাইটিসের সৃষ্টি হয়।

আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ

আর্থ্রাইটিসের উপসর্গগুলো সাধারণত হাড়ের জোড়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হাড়ের সন্ধিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়ার পাশাপাশি আরো যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে—

  • জয়েন্ট ফুলে যাওয়া
  • জয়েন্টের আকৃতি পরিবর্তন
  • পায়ের পাতায় ব্যথা
  • কোমর, ঘাড় ও পিঠে ব্যথা
  • শরীরের দুইপাশে একইসঙ্গে ব্যথা
  • আঙুল, কনুই, কাঁধ, গোড়ালি ও হাঁটুতে ব্যথা
  • দুই হাতের জয়েন্টে একসঙ্গে
  • ব্যথা ও ফুলে যাওয়া
  • জ্বর জ্বর অনুভূতি
  • দুর্বলতা

আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা

আর্থ্রাইটিসে ব্যথানাশক ওষুধ খেলে বা ইনজেকশন নিলে ব্যথার উপশম হয়। কিন্তু এটি এই রোগের মূল চিকিৎসা নয়। এটি সাময়িকভাবে ব্যথা কমতে সাহায্য করলেও সন্ধি নষ্ট হওয়া এড়ানো যায় না, বরং ওষুধ বন্ধ করলেই ব্যথা দ্বিগুণ আকারে দেখা দেয়। আর্থ্রাইটিস কখনো কখনো অস্থিসন্ধি ছাড়াও কিডনি, রক্তনালি, মস্তিষ্ক, ত্বকসহ নানা অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করে এর জটিলতা বাড়ানো যাবে না।

বর্তমানে সামান্য ব্যথা হলেই ব্যথার ওষুধের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরবর্তীকালে যা আমাদের লিভার ও কিডনি বিকল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল সমস্যার জন্ম দিতে পারে। আর্থ্রাইটিস উপশমে নানা ধরনের আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। তাই উপসর্গ দেখা দিলে ব্যথার ওষুধ সেবন না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

শীতের আগেই নিতে হবে প্রস্তুতি

শীত এলে শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে মাংসপেশিতে টান ধরে। তা ছাড়া এ সময় অনেকেই পানি কম পান করে, ফলে শরীরে পর্যাপ্ত তরলের ঘাটতি দেখা দেয়। মাংসপেশির আড়ষ্টতা বাড়ার ক্ষেত্রে এটিও বড়ো একটা কারণ। এছাড়া শীতকালে স্নায়ুর সহ্যক্ষমতা কম থাকে এবং স্বাভাবিক নড়াচড়া কম হয়। ফলে হাড়ের জোড়া জমে যায় এবং ব্যথার অনুভূতি অন্যান্য সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বেড়ে যায়।

যা খাবেন

এ সময় ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে খাবার ও শরীরচর্চা। যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন তারা সেটি চালিয়ে যাবেন। শীতকালে অনেকেই শরীরচর্চা বন্ধ রাখেন, তা করা যাবে না। প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটাহাঁটি করতে হবে, শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। শীতকালে বাজারে পাওয়া যায় প্রচুর বাহারি শাকসবজি ও ফলমূল। নিয়মিত সেসব মৌসুমি ফল ও সবজি খান। যদিও এমন কোনো নির্দিষ্ট খাবার নেই যেটি খেলে ব্যথা কমে যাবে। তবে, কিছু কিছু খাবার খেলে এবং কিছু খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকলে আর্থ্রাইটিসে ভোগান্তি কম হতে পারে।

যা খাবেন না

সপ্তাহে অন্তত দুইদিন বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ রাখুন খাদ্যতালিকায়। এতে আছে প্রদাহনাশক ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। খেতে পারেন বিভিন্ন ধরনের বাদাম। বাদামে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, ভিটামিন-ই ও ফাইবার। অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও আর্থ্রাইটিস—দুটোর জন্যই বাদাম বেশ উপকারী। এছাড়া হাড়কে শক্তিশালী করতে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে নিয়মিত দুধ, দই, পনির, ঘি, মাখন এসব দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খান। আর্থ্রাইটিসের কারণে সন্ধির ফোলাভাব কমাতে খুব ভালো কাজ করে শিম, মটরশুঁটি ও অন্যান্য আস্ত শস্যদানা বা বীজ। অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে হাড়কে রক্ষা করতে গ্রিন টি পান করতে পারেন। পলিফেনল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ এই পানীয় ব্যথা ও তরুণাস্থির ক্ষতির মাত্রা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আর্থ্রাইটিসের সমস্যা থাকলে গোরু ও খাসির মাংস এবং ফসফরাসসমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। এড়িয়ে চলতে হবে চিনি ও টম্যাটো। টম্যাটোতে থাকা ইউরিক অ্যাসিড হাড়ের জয়েন্টে জমে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়িয়ে তোলে। অতিরিক্ত চা, কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে কমিয়ে ফেলুন। এতে থাকা ক্যাফেইন শরীরকে পানিশূন্য করে তোলে, যা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়ায়। ধূমপান ও মদ্যপান শরীরের জন্য সবসময়ই ক্ষতিকর। তা ছাড়া অ্যালকোহল হাড়কে ভঙ্গুর করে তোলে। তাই হাড় সুস্থ রাখতে ও আর্থ্রাইটিসের সমস্যা কমাতে ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।

পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। তাছাড়া নিয়মিত হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ও শরীরচর্চা ব্যথা উপশমে দারুণ সহায়ক। আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। তাই ভয় পেয়ে ঘাবড়ে না গিয়ে সচেতনতার মাধ্যমে সুস্থ থাকুন। আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।


অধ্যাপক ডা. মোঃ আবু শাহীন

অধ্যাপক ডা. মো: আবু শাহীন

এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)
এমডি-রিউম্যাটোলজি (বিএসএমএমইউ)
মেডিসিন ও রিউম্যাটোলজি বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক, রিউম্যাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
চেম্বার : ল্যাবএইড লিঃ (ডায়াগনস্টিকস)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp