কনুইয়ে ব্যথা: টেনিস এলবো
-অধ্যাপক ডা. এ. কে. এম সালেক
শায়লা বেগম, বয়স ৫৫ বছর। ছেলেমেয়েরা সবাই নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে দুজনের সংসার। একসময় অবসর খুঁজতেন, এখন সারাদিনই যেন তার অবসর। রাঁধতে পছন্দ করেন। মেয়ের পরামর্শেই অবসর সময় কাটাতে ফেসবুকে হোমমেইড খাবারের পেজ খুলেছেন। আবারো ব্যস্ততা শুরু হওয়ায় বেশ ভালো সময় কাটছিল তার। কিন্তু কয়েক দিন ধরে হাতের ব্যথায় কিছুই করতে পারছেন না। রান্না দূরে থাক, চামচ নাড়তেই হাতের কনুইয়ে ব্যথায় চিৎকার করে উঠছেন।
ইমরান মাহমুদ, বয়স ৩৫ বছর। ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে টাইপিস্ট হিসেবে কর্মরত। বেশ কিছুদিন ধরে কনুই থেকে হাতের কবজি পর্যন্ত টনটনে ব্যথা অনুভব করছিলেন। শুরুতে তেমন গুরুত্ব দেননি। কয়েকদিন যাবৎ ব্যথার তীব্রতা বেড়ে গেছে। কী-বোর্ডে টাইপ করতে পারছেন না। এমনকি মাউস ধরতেও হাত ব্যথা হচ্ছে।
টেনিস এলবো নাকি বাতের ব্যথা
ওপরের দুটি ঘটনাই বাত রোগের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাত রোগ বলা হলেও এটি মূলত কোমল পেশির বাত যা কনুই সন্ধির ওপরের মাংসপেশিকে আক্রান্ত করে। হাতের কনুই থেকে শুরু করে আঙুল পর্যন্ত ব্যথায় শিরশির করে ওঠে। দৈনন্দিন কাজ করতে এমনকি হাত নাড়াচাড়া করতেও ব্যথা হয়। সাধারণভাবে এই রোগটি টেনিস এলবো নামে পরিচিত। রোগটি টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথম দেখা যায় বলেই এমন নামকরণ। রিউম্যাটোলজির পরিভাষায় একে বলা হয় ল্যাটারাল অ্যাপিকনডাইলিটিস।
সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের এই রোগে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে যারা কনুই বেশি ব্যবহার করেন, যেমন- গৃহিণী, প্রোগ্রামার, টেনিস খেলোয়াড়, পেশাদার বাবুর্চি যে কেউ টেনিস এলবোতে আক্রান্ত হতে পারেন।
উপসর্গ
টেনিস এলবো রোগের মূল লক্ষণ হচ্ছে ব্যথা। কনুই ভাঁজ বা সোজা করার সময় ব্যথা হতে পারে। অনেকসময় কবজি ডান থেকে বাম পাশে নাড়াচাড়া করলে ব্যথা বেশি হয়। পরিস্থিতি জটিল হলে হাতের সামান্য নড়াচড়াতেও তীব্র ব্যথা হয়।
এছাড়াও যেসব উপসর্গ দেখে টেনিস এলবো বোঝা যেতে পারে—
- ভারী জিনিস তুলতে হাতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়া।
- হাত নাড়াচাড়া করতে ও কাজ করতে অসুবিধা হওয়া।
- হাত ভাঁজ করা বা মুষ্টিবদ্ধ করতে ব্যথা হওয়া।
- ভেজা কাপড় নিংড়ানো, চামচ দিয়ে কিছু নাড়ানো বা করমর্দনে অসুবিধা হওয়া।
- দরজা খুলতে বা বন্ধ করতেও অসুবিধা হতে পারে।
- কনুই থেকে শুরু হয়ে হাতের আঙুল পর্যন্ত ব্যথা হতে পারে।
- কনুই ফুলে যেতে পারে।
- ব্যথার স্থানে চামড়ার রং পরিবর্তন হতে পারে।
ঝুঁকিতে আছেন যারা
সাধারণত ডায়াবেটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও অন্যান্য বিপাকজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। টেনিস খেলার সময় যারা বেকায়দায় ব্যাট ধরেন তাদের পেশিতে ক্রমাগত চাপ পড়ে। চাপের কারণে ধীরে ধীরে পেশিমূল ও অস্থির আবরণের মাঝে ক্ষত তৈরি হয়। পরবর্তীকালে এই ক্ষত থেকে প্রদাহ হতে পারে। টেনিস এলবোতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে যাদের—
- টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়।
- হাতুড়ি ও স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহারকারী।
- কাঠমিস্ত্রি, পেইন্টার বা রংমিস্ত্রি।
- পেশাদার বাবুর্চি।
- টাইপিস্ট, স্টেনোগ্রাফার।
- মোটরসাইকেল চালক।
- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী।
- রান্না ও সাংসারিক কাজে ব্যস্ত নারী।
- বিভিন্ন ধরনের আর্থ্রাইটিস যেমন— রিউমাটয়েড, গাউটে আক্রান্ত ব্যক্তি।
চিকিৎসা
ঘরোয়া কাজ, মোটরসাইকেল চালানো, ভারী জিনিস উত্তোলন বা কম্পিউটারের মাউস ধরে একটানা কাজ করলে কনুই ব্যথা হতে পারে। হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত ব্যথা ও স্বাভাবিক কাজ করতে অসুবিধা হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। অনেকসময় শুধু উপসর্গ বুঝে রোগের কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। কারণ জানতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
টেনিস এলবো রোগের কারণ শনাক্ত করতে এক্স-রে, এমআরআই বা মাস্কুলোস্কেলিটাল পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত এর চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এই রোগের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি বেশ উপকারী। আল্ট্রাসাউন্ড, আইস ম্যাসাজ, মাসল হিটিং— ফিজিওথেরাপির এই পদ্ধতিগুলো লিগামেন্টের ক্ষত পূরণ করে।
যদি বারবার একই কাজ করার সময় ব্যথা বাড়ে তাহলে সেই কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সময় কনুই পুরোপুরি বিশ্রামে রাখতে হবে। নড়াচড়া এড়াতে এলবো ব্যাগ ব্যবহার করা ভালো। অতিরিক্ত বিশ্রামে কনুই শক্ত হয়ে জমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যথা কমে এলে পেশি সচল রাখতে হাত নাড়াচাড়া ও ব্যায়াম করা যেতে পারে।
প্রয়োজন অনুযায়ী ঠান্ডা বা গরম তাপ প্রয়োগ করলে রোগী কিছুটা আরাম পেতে পারেন। টেনিস এলবোতে যখন ওষুধ বা ফিজিওথেরাপি কোনোকিছুতেই কাজ হয় না তখন সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। জটিলতা বাড়লে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এফসিপিএস (ফিজিক্যাল মেডিসিন)
বাতরোগ, ব্যথা ও রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও
রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
চেম্বার: ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিকস)