কান ও গলাব্যথার কারণ

-ডা. এম. আর. ইসলাম

ঠান্ডা বা ফ্লু’র খুব সাধারণ একটি উপসর্গ গলাব্যথা। কিন্তু গলাব্যথার সঙ্গে কানে ব্যথা হলে বুঝতে হবে সমস্যা অন্য কোথাও। সাধারণত জীবাণুর সংক্রমণ বা কানে প্রদাহের ফলে ব্যথা হয়ে থাকে। গলার যেকোনো সমস্যা হলে কানে তার প্রভাব পড়তে পারে। টনসিলাইটিস, অ্যালার্জি কিংবা গলা বা মুখের অন্য কোনো রোগ একই সঙ্গে গলাব্যথা ও কানে ব্যথার কারণ হতে পারে।

গলাব্যথার নানা কারণ

টনসিলাইটিস গলাব্যথার সবচেয়ে প্রচলিত কারণ। এছাড়া ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, সাইনাসে সংক্রমণ, অ্যালার্জি, গলার ঘা, দাঁতের সমস্যা প্রভৃতি কারণে গলাব্যথা হয়।

ভাইরাস সংক্রমণ: ফ্লু ভাইরাস, করোনাভাইরাস, চিকেনপক্স ইত্যাদি ভাইরাসের সংক্রমণ হলে গলাব্যথা হয়।

ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ: ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে যে গলাব্যথা হয়ে থাকে তা অত্যন্ত তীব্র। ঢোক গিলতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। এতে টনসিল ফুলে যেতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি সাইনোসাইটিস: সাইনাসে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘটলে তা পোস্ট নাসাল ড্রিপের কারণ হতে পারে। অর্থাৎ তখন নাকের শ্লেষ্মা গলার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই সংক্রমিত শ্লেষ্মা গলাব্যথা তৈরি করে।

অ্যালার্জি: অনেকের অ্যালার্জি সংবেদনশীলতা থাকে। ধুলো-ময়লা, ফুলের রেণু, পশুপাখির পালক, খুশকি প্রভৃতির কারণে অ্যালার্জি হয় এবং তা গলাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অ্যাসিড রিফ্লাক্স: এটি পাকস্থলির একটি রোগ। চিকিৎসার ভাষায় একে গ্যাস্ট্রোএসোফেগিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) বলা হয়। এটি হলে পাকস্থলির অ্যাসিড উঠে আসে ওপরের দিকে। এতে গলাব্যথা হয়। এমনকি গলার স্বরও পরিবর্তিত হতে পারে।

গলাব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে হার্ট বা কিডনিতে
ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

উত্তেজক পদার্থ: শুষ্ক বাতাস, সিগারেটের ধোঁয়া, কেমিক্যালস, গ্যাস থেকে নির্গত ধোঁয়া-পরিবেশের এসব উত্তেজক পদার্থ মিউকাস মেমব্রেনে জটিলতা তৈরি করে। এই জটিলতা শ্বাসনালি ও ফুসফুসের ক্ষতি করে। ক্ষতিগ্রস্ত শ্বাসনালি ও ফুসফুস শ্বাসকষ্ট তৈরি করে এবং গলাব্যথা হয়ে থাকে।

ল্যারিঞ্জাইটিস: ল্যারিঞ্জাইটিস হচ্ছে ভয়েস বক্সের প্রদাহ। সংগীতশিল্পী বা গলার স্বরের অতিরিক্ত ব্যবহার করতে হয় যাদের তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি হয়ে থাকে। ল্যারিঞ্জাইটিস হলে গলাব্যথার পাশাপাশি গলার স্বর কর্কশ হয়ে যায় এবং কথা বলতে অসুবিধা হয়।

গলাব্যথার চিকিৎসা
সাধারণ কারণে গলাব্যথা হলে এমনিতেই অল্পদিনে সেরে যায়। হালকা গরম পানি দিয়ে গার্গল করা, গরম স্যুপ বা চা পান-প্রভৃতি প্রাথমিক চিকিৎসায় না সারলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। গলাব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে হার্ট বা কিডনিতে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

কানে ব্যথা কেন হয়
‘কান টানলে মাথা আসে’—প্রবাদটি কিন্তু আক্ষরিক অর্থেও সত্যি। দেহের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গসমূহের মধ্যে কান অন্যতম। আর কানে সমস্যা হলে তার প্রভাব পড়ে মাথায়। কানের নিজস্ব সমস্যার জন্য যেমন কানে ব্যথা হয়, তেমনি কানসংশ্লিষ্ট অন্যান্য অঙ্গের সমস্যার জন্যও কানে ব্যথা হয়।

ওটিটিস মিডিয়া
মধ্যকর্ণে জীবাণুর সংক্রমণজিত প্রদাহ হচ্ছে ওটিটিস মিডিয়া। এতে কানের পর্দায় তরল জমে যায় এবং কানে ব্যথাসহ জ্বর, মাথাব্যথা হয়।

ওটিটিস এক্সটার্নাল
কানের সরু ছিদ্রপথে অনেকসময় জীবাণুর সংক্রমণ হয়। তখন কান ভারী ভারী লাগে, চুলকায় এবং কানের লতি নাড়াচাড়া করলে ব্যথা পাওয়া যায়। কান ফোলা, কম শোনা বা কান হলদেটে হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।

কানের খইল
অতিরিক্ত খইল জমে কান বন্ধ হয়ে গেলে কানে অস্বস্থি তৈরি হয়। কানে শুনতে অসুবিধা হয়। কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়।

কানের পর্দায় ছিদ্র
সংক্রমণজনিত বা আঘাতজনিত কারণে কানের পর্দা ছিদ্র বা ফুটো হতে পারে। এক্ষেত্রে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি কানে তীব্র ব্যথা হয়।

কানের ত্বকে সমস্যা
কানের ত্বক অ্যালার্জি বা জীবাণুর সংক্রমণের শিকার হলে কানে ব্যথা, চুলকানি, ছোটো গুটি হওয়ার মতো সমস্যা হয়।

সাইনোসাইটিস
সাইনাসে সংক্রমণ বা প্রদাহের ফলেও কানে সমস্যা হয়।

দাঁতের সমস্যা
ফাঁটা বা ভাঙা দাঁত, দাঁতের গোড়ায় মাংস জমা প্রভৃতি কারণেও কানে ব্যথা হয়ে থাকে।

চোয়ালের অস্থিসন্ধির সমস্যা
একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে, টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্ট (টিএমজে)। এতে কানব্যথা হওয়ার পাশাপাশি মাথাব্যথা ও ঘুমের সমস্যা হতে পারে।

কানের সুরক্ষায় করণীয়

  • কটন বাড ব্যবহার করবেন না।
  • ম্যাচের কাঠি বা এরকম কিছু দিয়ে খোঁচাবেন না।
  • দীর্ঘক্ষণ কানে মোবাইল ধরে কথা বলবেন না।
  • বেশিক্ষণ ইয়ারফোনে গুঁজে রাখবেন না।
  • কানে ব্যথা হলে হালকা সেঁক নিতে পারেন।
  • লক্ষ রাখবেন, কানে যেন কোনোভাবে পানি না যায়।

সমস্যার প্রকৃত কারণ না জেনে নিজে নিজে চিকিৎসা করতে যাবেন না। এটি বড়ো ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। কানে-গলায় সমস্যা হলে নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরাণাপন্ন হোন।


ডা. এম. আর. ইসলাম

ডা. এম. আর. ইসলাম
এমবিবিএস, এমএস (ইএনটি)
নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ও হেড-নেক সার্জন
প্রাক্তন কনসালট্যান্ট
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ক্যানসার হাসপাতাল
অনারারি অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp