করোনারি হার্ট ডিজিজের কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা

ডা. নুর মোহাম্মাদ

বিশ্বজুড়ে মানবমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদ্‌রোগ। হৃদ্‌রোগের নানা ধরন রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত একটি ধরন হচ্ছে করোনারি হার্ট ডিজিজ। একে করোনারি আর্টারি ডিজিজ কিংবা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজও বলা হয়। কেবল জরিপ বা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই নয়, বাস্তবিক অভিজ্ঞতা থেকেও দেখা যাচ্ছে, সারা বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের দেশেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এমনকি জীবনঘাতী এই রোগটি বয়স বা লিঙ্গভেদও মানছে না। যেকোনো বয়সী নারী-পুরুষ হামেশাই এতে আক্রান্ত হচ্ছেন।

করোনারি হার্ট ডিজিজ কী?

এটি মূলত হৃৎপিণ্ডের ধমনির একটি জটিল রোগ। এ অবস্থায় হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী প্রধান ধমনিগুলো পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন কারণে ধমনির গায়ে কোলেস্টেরল বা চর্বির আস্তর জমা হয়। তারপর বিভিন্ন ধরনের রক্তকণিকা জমে প্লাক তৈরি হয়। অনেক সময় প্রদাহের কারণেও এমন হয়। এ রকম হলে রক্তনালিগুলো হৃৎপিণ্ডে প্রয়োজনীয় রক্ত, অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে না। এই সমস্যাটিকেই বলা হয় করোনারি হার্ট ডিজিজ বা করোনারি আর্টারি ডিজিজ।

করোনারি হার্ট ডিজিজের কারণ

এমন কিছু কারণ রয়েছে যেগুলোর উপস্থিতি এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন—

বংশগত ইতিহাস : বাবা-মা কিংবা পরিবারে অন্য কারো হৃদ্‌রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের ভেতরেও এই রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি থেকে যায়।

লিঙ্গভেদ : নারীদের চেয়ে পুরুষদের এই রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। তবে মেনোপজের পর নারীদের ভেতরেও এর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এমনকি গর্ভকালীন জটিলতার দরুনও করোনারি হার্ট ডিজিজ হতে পারে।

ধূমপান : ধূমপান হৃদ্‌রোগের কারণ—আমাদের নিকট অতি পরিচিত একটি পঙ্ ক্তি। কথাটি কিন্তু সর্বাংশে সত্যি। সিগারেটে থাকা নিকোটিন ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ হৃৎস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

অন্যান্য কিছু শারীরিক জটিলতা : যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো শারীরিক জটিলতা আছে তাঁদের হৃদ্‌রোগে, বিশেষত করোনারি হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। অতিরিক্ত দৈহিক ওজন বা স্থূলতাও হৃদ্‌রোগের অন্যতম কারণ। দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ থাকলে তা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিসকে বলা হয় করোনারি হার্ট ডিজিজের সূতিকাগার। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরাই পরবর্তী সময়ে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় যৌবন বয়সে নারীরা কিছুটা হৃদ্‌রোগমুক্ত থাকলেও ডায়াবেটিস হলে এ সূত্র আর থাকে না।

ভুল জীবনযাপন-পদ্ধতি : নিয়মিত শরীরচর্চা না করা, ঠিকমতো না ঘুমানো, শারীরিক পরিশ্রম না করা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মদ্যপান—প্রভৃতি কারণে হৃৎপিণ্ডের ধমনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে বাড়তে পারে করোনারি হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি। দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

করোনারি হার্ট ডিজিজের লক্ষণ

উল্লিখিত কারণগুলোর ফলাফল হিসেবে আমাদের হৃৎপিণ্ড ভেতরে ভেতরে জটিল অবস্থার দিকে যেতে থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই আমরা তা টের পাই না। সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের মতো বড় কোনো সমস্যা না হলে অন্য লক্ষণগুলো আমাদের চোখেই পড়ে না। অথচ গুরুতর পর্যায়ে যাওয়ার আগে অনেক লক্ষণ ও উপসর্গ প্রকাশ পায়।

বুকে ব্যথা : এই ব্যথা হয় বুকের মাঝামাঝি জায়গায়। বুকে চাপ বা টান লাগার মতো অনুভূতি হয়। ব্যথাটি ঘাড়, চোয়াল ও হাতসহ বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। অল্প সময়ের জন্য হলেও এই ব্যথা তীব্র হয়। সাধারণত হাঁটতে, দৌড়াতে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে, ভারী কোনো কাজ করতে, বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হলে ধরে নিতে হবে এটি হার্টের অসুখের ব্যথা।

শ্বাসকষ্ট : স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় যে দম ফুরিয়ে আসছে।

হার্ট অ্যাটাক : রোগী আচমকা হার্ট অ্যাটাকের শিকার হলে বুকে প্রচণ্ড ব্যথাসহ শরীর ঘেমে যেতে থাকে। বমিভাব বা বমি হতে পারে।

অজ্ঞান হয়ে যাওয়া : করোনারি হার্ট ডিজিজের শিকার হলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।

ক্লান্তি : পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের অভাবে এ সময় তীব্র ক্লান্তিবোধ হয়।

করোনারি হার্ট ডিজিজের চিকিৎসা

এই রোগের চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। যেমন—ধূমপান পরিহার করা, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনা, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রভৃতি। পাশাপাশি ওষুধও দেওয়া হয়। এসবে কাজ না হলে করোনারি অ্যানজিওগ্রাম করে ধমনির সরু হয়ে যাওয়া জায়গায় স্টেন্ট বা রিং পরানো হয়। কিন্তু ব্লক যদি বেশি হয় এবং একাধিক জায়গায় হয় সে ক্ষেত্রে দরকার হয় অস্ত্রোপচার বা বাইপাস সার্জারি। কিন্তু রোগী হার্ট অ্যাটাকের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যানজিওগ্রাম করে ব্লক খুলে রিং লাগালে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে।

সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা জরুরি। যাঁদের বয়স বেশি তাঁদের মাঝেমধ্যেই হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা পরীক্ষা করা দরকার। যাঁদের বয়স ত্রিশের ঘর পেরিয়েছে তাঁদেরও আকস্মিক বড় কোনো জটিলতা এড়ানোর জন্য বছরে অন্তত একবার পরীক্ষা করানো উচিত।

---