করোনার বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট

অধ্যাপক ডা. এস.এম. মোস্তফা জামান

পৃথিবীতে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং ভাইরাস থেকে সৃষ্ট মহামারির ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৩৪৮ সালের প্লেগে সারাবিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। আবার ১৫২০ সালে স্পেন ও পর্তুগাল থেকে ছড়ানো গুটি বসন্তে ঐ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ উজাড় হয়ে যায়। সবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ঘরে ফেরা সৈন্যদের থেকে ছড়ানো ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতেও প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। বলা হয়ে থাকে, স্প্যানিশ ফ্লুতে গোটা বিশ্বের ৩ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারায়। ১৩৪৬, ১৫২০ কিংবা ১৯১৮ সালের মতো ২০২০ সালকে মানুষ বিপর্যয়ের একটা বছর হিসেবে মনে রাখবে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কোভিড-১৯ এর ফলে বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যু এরই মধ্যে অর্ধকোটি ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া এই মহামারির ফলে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও। প্রতিনিয়ত রূপ বদল এবং নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির কারণে ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে গবেষকদের। প্রথমে বৈজ্ঞানিক নাম কিংবা যে দেশে ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া গেছে সেই দেশের নাম অনুযায়ী ডাকা হলেও এ ব্যাপারে প্রথম আপত্তি তোলে ভারত। পরবর্তী সময়ে ডাব্লিউএইচও করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলির নামকরণের জন্য গ্রিক বর্ণমালার অক্ষরগুলি বেছে নেয়। যেমন- ব্রিটেনে পাওয়া ভ্যারিয়েন্ট আলফা, দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া ভ্যারিয়েন্ট বিটা, ব্রাজিলে শনাক্ত হওয়া ভ্যারিয়েন্ট গামা, ভারতের ডেলটা এবং সর্বশেষ পেরুতে শনাক্ত হয়েছে ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কোভিড-১৯ এর ফলে বিশ্বব্যাপী
মোট মৃত্যু এরই মধ্যে অর্ধকোটি ছাড়িয়ে গেছে।

ব্রিটেনের আলফা ভ্যারিয়েন্ট
গত বছর সেপ্টেম্বরে ব্রিটেনে করোনাভাইরাসের নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া যায়। নভেম্বর নাগাদ লন্ডনের এক চতুর্থাংশ মানুষই এই ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর এই হার ডিসেম্বরেই হয়ে যায় দুই তৃতীয়াংশ। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ড. এরিক ভলজ এর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি অন্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় সত্তর শতাংশ বেশি সংক্রামক। চীনের উহানে শনাক্তকৃত ভ্যারিয়েন্ট থেকে ব্রিটেনে প্রাপ্ত ভ্যারিয়েন্টে স্পাইক প্রোটিন, রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে পরিবর্তনসহ ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন পাওয়া গিয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিটা ভ্যারিয়েন্ট
গত বছরের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে করোনাভাইরাসের বিটা ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে এটি বেশ সক্রিয় হয়ে উঠে। করোনাভাইরাসের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটি ৬০ শতাংশ বেশি সংক্রামক।আফ্রিকা মহাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩৪ লাখেরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৮৭ হাজারেও বেশি মানুষের। এটি শিশু ও কমবয়সীদের বেশি আক্রান্ত করে থাকে। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের মাঝে নতুন কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। যেমন- শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, অত্যধিক গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হওয়া, রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে পচন ধরার মতো সমস্যা হয়।

ব্রাজিলের গামা ভ্যারিয়েন্ট
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার সবগুলো ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত রূপ বদলাতে সক্ষম ব্রাজিলের গামা ভাইরাস। শরীরে অ্যান্টিবডির প্রভাব এড়িয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারদর্শী এই ভ্যারিয়েন্টটি। এমনকি টিকা নেওয়ার পরেও টিকার ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি এড়াতে রূপ বদলে ফেলতে সক্ষম ব্রাজিলের গামা ভ্যারিয়েন্ট। এটি কম বয়সীদের বেশি আক্রান্ত করে। গামা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের বেশিরভাগের বয়সই ৪০ বছরের নিচে।

ভারতের ডেলটা ও ডেলটা প্লাস ভাইরাস
করোনাভাইরাসের ই.১.৬১৭.২ স্ট্রেইনকে বলা হচ্ছে ‘ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট’। ঊ৮৪৮ছ ও খ৪৫২জ নামের দুটি আলাদা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট থেকে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি ঘটেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং নমুনা পরীক্ষার পর ভারতের মহারাষ্ট্রে প্রথম এই ডবল মিউটেশনের লক্ষণটি ধরা পড়ে। গবেষকদের মতে, অন্যান্য সব ভ্যারিয়েন্টের থেকে অনেক বেশি মারাত্মক এই ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট সম্প্রতি দ্বিতীয় দফায় রূপ পরিবর্তন করেছে। ইউরোপে শনাক্ত হওয়া ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের এই পরিবর্তিত রূপটির নাম দেওয়া হয়ে ডেলটা প্লাস। গবেষকদের মতে, ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক এই ডেলটা প্লাস ভ্যারিয়েন্টটি। ডেলটা প্লাস ভ্যারিয়েন্টে ক৪১৭ঘ নামে একটি অতিরিক্ত মিউটেশন রয়েছে, যেটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে শনাক্ত হওয়া বিটা ও গামা ভ্যারিয়েন্টেও পাওয়া গেছে।

পেরুর ল্যাম্বডা
পেরুতে পাওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টটির নাম দেওয়া হয়েছে ল্যাম্বডা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ল্যাম্বডা আক্রান্তদের মৃত্যুহার প্রতি এক লাখে ৬০০ জন। ইতোমধ্যে পেরুসহ অন্তত ২৮টি দেশে ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। গবেষকদের মতে, আলফা, বিটা, ডেলটা, ডেলটাপ্লাস, ল্যাম্বডা; এগুলোর বাইরে আরও কিছু ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- কাপা, লটা, থেটা, এটা, যেটা, এপসিলন। এখনো মারাত্মক আকার ধারণ না করলেও একাধিক দেশের কিছু এলাকায় এসব ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেছে। নতুন চিহ্নিত হওয়া এসব ভ্যারিয়েন্টগুলোর ওপর বিজ্ঞানীরা সতর্ক নজর রাখছেন।


অধ্যাপক ডা. এস.এম. মোস্তফা জামান
এমবিবিএস, ডিটিসিডি, এমডি (কার্ডিওলজি)
ফেলো-ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি
(ভারত, সিঙ্গাপুর ও জাপান)
হৃদরোগ, বাতজ্বর, বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল।

LinkedIn
Share
WhatsApp