করোনা ও করোনার টিকা গুজব ও সত্যতা

ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার

সারা বিশ্ব যখন ব্যস্ত করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ঠিক তখন আমাদের দেশের চিকিৎসক থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাইরাসের পাশাপাশি সামাল দিতে হয়েছে ভাইরাসের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গুজবকে। উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল মানুষ বলা শুরু করল, করোনা হচ্ছে পাপের ফল। আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান কিংবা গড প্রদত্ত শাস্তি। স্বপ্নে করোনার ওষুধ পাওয়া কিংবা টিকা তৈরির সূত্র, থানকুনি পাতা কিংবা পেপে পাতায় আরোগ্যলাভ অথবা টিকার মাধ্যমে শরীরে মাইক্রোচিপ বসিয়ে দেওয়ার মতো

কোনো খবর শোনামাত্রই বিশ্বাস না করে একটু যাচাই করে নিন।
গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন।

গুজবের ফলে সাধারণ মানুষ শুরু থেকেই কোভিড-১৯ কে বেশ হালকাভাবে নিয়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে সচেতনতার অভাব। আর এই সুযোগেই ভাইরাস যেমন ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুতগতিতে তেমনই টিকা নিতেও অনেকের মধ্যে আপত্তি দেখা গিয়েছে। করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ছড়ানো কিছু গুজব ও সত্যতা সম্পর্কে জেনে নিন।

‘গরমকালে করোনা ছড়ায় না’
গত বছর শীতের শেষের দিকে বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে তখন সাধারণ মানুষের ভেতর অতিদ্রæত একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তা হলো, গরমকালে করোনাভাইরাস ছড়ায় না। গুজবটি জনমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কথাটির সত্যতা যাচাই-বাছাই না করেই অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। করোনার মতো মরণঘাতী ভাইরাসটিকে অনেকে রীতিমতো হালকাভাবে নিতে থাকে। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, গরমে করোনার সংক্রমণ হবে না কিংবা সংক্রমণ কমে যাবে, এই ধারণাটি ঠিক নয়। আবহাওয়া ও পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে সংক্রমণের কোনো সম্পর্ক নেই। করোনা যেকোনো তাপমাত্রায় সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

‘করোনা হচ্ছে স্রষ্টাপ্রদত্ত শাস্তি’
করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে অনেকে বলতে লাগলেন, করোনাভাইরাস হচ্ছে স্রষ্টার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য পরীক্ষা। কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে একে অভিশাপ হিসেবে অভিহিত করলেন। গুজব ছড়ালেন, করোনাভাইরাস এসেছে নরক থেকে পাপীদের জন্য এবং এর সমাধান আসবে স্বর্গ থেকে। এমন অপব্যাখ্যা কেবল আমাদের দেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাতেও ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তুত এসব ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিপরীত। সচেতন মানুষমাত্রই এ কথা স্বীকার করবেন যে, রোগজীবাণুর উৎস যাই হোক, এসব ধর্মীয় অপব্যাখ্যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

‘স্বপ্নে পাওয়া টিকার সূত্র’
কোভিড-১৯ এর আক্রমণে সারাবিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যখন রীতিমতো টালমাটাল, চিকিৎসাবিজ্ঞান এই মরণঘাতী ভাইরাস প্রতিরোধে যখন কোনো ক‚ল-কিনারা করে উঠতে পারছে না, তখন একটি গুজব মরণঘাতী ভাইরাসের মতোই ছড়িয়ে পড়ল মুহুর্তে। কিছু সুবিধাভোগী ফন্দিবাজ মানুষ স্বপ্নে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক পাওয়ার কথা দাবি করতে লাগল। অতি উৎসাহী লোকজনের অসচেতন ভ‚মিকায় সেসব সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েও পড়ল খুব দ্রুত। এসব গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বাজারে এসেছে তা বিজ্ঞানীদের গত দেড় থেকে দুই বছরের গবেষণার ফল।

‘থানকুনিপাতা, কালো জিরা খেলে করোনায় মুক্তি মেলে’
বাংলাদেশে করোনারোগী শনাক্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, থানকুনি পাতা ও কালোজিরা খেলে করোনার সংক্রমণ হবে না।কিছু ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালও তা ফলাও করে প্রচার করে। ফলে মুহূর্তেই বাজার থেকে থানকুনি ও কালোজিরা উধাও হয়ে যায়।

এমনকি গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আনাচে-কানাচে জন্মানো থানকুনিও লোপাট হয়ে যায়। থানকুনি ও কালোজিরা শরীরের জন্য বেশ উপকারী, এ কথা সত্য। কিন্তু এই দুটি জিনিস খাওয়া না খাওয়ার সঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

‘টিকার মাধ্যমে মাইক্রোচিপ বসানো হচ্ছে’
‘কোভিডের টিকার মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন এক মাইক্রোচিপ যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে মানুষের মন ও গতিবিধি’, ‘বদলে দেওয়া যাবে ডিএনএর ধরন’- এমন গুজবের ফলে টিকা গ্রহণে ভীতি ও অনীহা দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, টিকার মধ্যে মাইক্রোচিপ আছে এমন কোনো প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বরং টিকা গ্রহণকারীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের থেকে কম।

‘রসুন খেলে করোনা হয় না’
রসুন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য উপাদান। ক্যানসারসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দূরীকরণে এর ভ‚মিকা রয়েছে। রক্তসঞ্চালন, হৃৎপিন্ডের শক্তি বাড়ানো, যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও রসুন বেশ উপকারী। এটি উচ্চ রক্তচাপ কমায়। দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে রসুনের রয়েছে দারুণ ভ‚মিকা। ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধেও রসুন ভালো একটি খাবার। কিন্তু রসুন খাওয়ার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়, এরকম কোনো প্রমাণ নেই।

‘টিকা গ্রহণে প্রজননক্ষমতা কমে যায়’
কোভিড-১৯ এর টিকা গ্রহণের মাধ্যমে নারীদের সন্তান ধারণ ক্ষমতা, পুরুষের স্পার্ম কাউন্ট কমে যায় এবং মানবদেহের প্রজননতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি হয় বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে ভয় পেয়ে টিকা নেওয়া থেকে পিছিয়ে গিয়েছেন অনেকেই। টিকা গ্রহণের ফলে বন্ধ্যাত্বের কোনো প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনকি টিকার ট্রায়াল চলাকালে গর্ভধারণ করেছেন এমন অনেকের ওপর টিকার প্রয়োগ করা হয় দেখা গেছে টিকা নেয়ার ফলে প্রজনন বা ভ্রুণের বিকাশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

‘নিউমোনিয়া বা জ্বরের টিকায় করোনা প্রতিরোধ’
আগে থেকে নিউমোনিয়া বা কোনো জ্বরের টিকা নেওয়া থাকলে করোনায় সংক্রমিত হবে না বলে একটি গুজব ছড়িয়েছিল এক সময়। নিউমোনিয়া বা জ্বরের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সরাসরি সম্পর্ক আছে, এ কথা সত্য। কিন্তু তাই বলে নিউমোনিয়া বা জ্বরের প্রতিষেধক করোনার ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে এমনটি ভাবা ঠিক নয়।


ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার
ব্যবস্থাপক, মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স
ল্যাবএইড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp