অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা
২০২০ এর মার্চে বাংলাদেশে করোনারোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্কসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসরঞ্জাম। হু-হু করে দাম বাড়তে থাকে এসব উপকরণের। এর কিছুদিন পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি ওষুধের তালিকা। আর নিমেষেই সেসকল ওষুধ পার্শ্ববর্তী ফার্মেসিগুলো থেকে গায়েব হয়ে যায়। করোনার শুরু থেকেই এর চিকিৎসা নিয়ে বেশ উদ্বেগ সাধারণ মানুষের। তাই কখনো ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট, কখনো সর্দি কাশির ওষুধ আর কখনো বা থানকুনি পাতা কিংবা কালো জিরা নিয়ে কিংবা চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে যখন যে তথ্য গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে তার উপরেই হামলে পড়েছে সবাই। তবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এর তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে আশাব্যঞ্জক কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে আইভারমেকটিন থেকে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র,
বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এর তথ্য অনুযায়ী
কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে আশাব্যঞ্জক
কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে আইভারমেকটিন থেকে।
আইভারমেকটিন কী?
আইভারমেকটিন একটি অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ। শুরুতে আইভারমেকটিন শুধু গৃহপালিত প্রাণীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো। এরপর গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, এই ওষুধ মানুষের জন্য নিরাপদ। বিগত ত্রিশ বছর ধরে এই ওষুধের প্রয়োগ হয়ে আসছে। ওষুধটি কৃমি, উকুন, খোশ-পাঁচড়া, এইচআইভি-১ ভাইরাস, সিমিয়ান এসভি-৪০ ভাইরাস, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, ভেনেজুয়েলান ইকুইন এনসেফালাইটিস ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, ডেঙ্গু ভাইরাস, পীত রোগসহ আরো কয়েকটি আরএনএ ভাইরাসঘটিত রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। এটি মশাবাহিত রোগের বিরুদ্ধেও কার্যকর। কেমোথেরাপির ফলে ক্যানসারকোষের ওষুধ সহ্য করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করলে আইভারমেকটিন এক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইউএসএফডিএ) মানুষের ওপর কিছু কিছু রোগের জন্য আইভারমেকটিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
কোভিড ১৯ প্রতিরোধে আইভারমেকটিন কি কার্যকর?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, চিকিৎসাসংক্রান্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান
এবং চিকিৎসকদের ভেতর এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
তবে বিভিন্ন দেশে অনেক চিকিৎসকই করোনা আক্রান্ত
হলে আইভারমেকটিন সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন।
করোনার বিরুদ্ধে আইভারমেকটিন
আইভারমেকটিনের এই বহুমুখী কার্যকারিতার ফলে পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন দেশে ৭০৪ জন করোনারোগীকে আইভারমেকটিন দেওয়া হয়। দেখা গেছে, যাদের ভেন্টিলেটরের দরকার তাদের মধ্যে মৃত্যুহার ২১.৩ শতাংশ থেকে কমে ৭.৩ শতাংশে নেমে আসে এবং সামগ্রিক ভাবে ৮.৫ শতাংশ মৃত্যুহার থেকে ১.৪ শতাংশে নেমে আসে।
এমনকি বাংলাদেশেও ঢাকার তিনটি করোনা হাসপাতালে ৬৮ জন রোগীকে আইভারমেকটিন সেবন করানো হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় মৃদু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আইভারমেকটিন অথবা আইভারমেকটিনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন ব্যবহার করে আশা জাগানিয়া ফলাফল পাওয়া গেছে। আইসিডিডিআরবি’র গবেষকরা বলেছেন, কেউ করোনা সংক্রমিত হওয়ার প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে এই ওষুধটি সেবন করলে তার সংক্রমণের মাত্রা কমে যায়
উল্লেখযোগ্যভাবে।
৬ মে ২০২০ টুইটারে ফিজিশিয়ানদের নিয়ে হওয়া ৫৪ জন ডাক্তারের একটি সার্ভেতে দেখা গেছে, ৬১.১ শতাংশ মনে করেন, করোনার বিরুদ্ধে আইভারমেকটিন নিশ্চিত কাজ করে। ২০.৪ শতাংশ মনে করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করে। মাত্র ৭.৪ শতাংশ মনে করেন, একদম কাজ করে না এবং ১১.১ শতাংশ মনে করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করে না।
কী বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা আক্রান্ত রোগীকে আইভারমেকটিন প্রয়োগের বিরোধিতা করেছে। ডবিøউএইচও’র বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন টুইট করে জানিয়েছেন- “কেনো নতুন ওষুধ প্রয়োগের আগে তার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে ভাবতে হবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন রয়েছে। আইভারমেকটিন প্রয়োগে সায় নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।”
করোনা পরিস্থিতিতে আইভারমেকটিন একটি অতি পরিচিত ওষুধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা পজিটিভদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ওষুধ সুপারিশ করছেন চিকিৎসকরা। তবে, আগে থেকে খেয়ে রাখলে সংক্রমণ হবে না এই ধারণা ভিত্তিহীন। কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা যাবে না। আইভারমেকটিনের ব্যবহার করোনা আক্রান্ত রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে পারে কিন্তু সংক্রমণ প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা।
অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা
এমবিবিএস, পিএইচডি (মেডিসিন)
এফএসিপি, এফআরসিপি (এডিন)
অনারারি প্রফেসর, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
মেডিসিন বিশেষজ্ঞসিনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল