করোনা-পরবর্তী জটিলতা ও করণীয়

ডা. মো: সাইদুল ইসলাম

কেস স্টাডি-১
এ বছর ফেব্রুয়ারির দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন ফারুক হোসেন। প্রথম দুদিন জ্বর এবং স্বাদ গন্ধ চলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো জটিলতা ছিল না। ফলে দু’সপ্তাহ পর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাজে যোগদান করেন। পেশায় সাংবাদিক ফারুক হোসেন কাজে যোগদানের কয়েকদিন পরেই লক্ষ করলেন, মানসিক ও শারীরিক অবসাদের পাশাপাশি বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে তার। এমনকি করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর শ্বাসকষ্ট না হলেও সেরে ওঠার পর শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

কেস স্টাডি-২
সামিরা খানম একজন গৃহিনী। মার্চে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর, বাড়ি ফিরে পূর্বের মতোই সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সপ্তাহখানেক পরেই হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যান। দেখা যায়, তার উচ্চরক্তচাপ মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।

করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠেছেন এরকম ৫০-৭০ শতাংশ রোগী ৩-৬ মাস পর্যন্ত ছোটোখাটো বা বড়ো বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা, অর্থাৎ পোস্ট কোভিড সিনড্রোমে ভুগছেন বলে জানা গেছে। এই জটিলতা অনেকসময় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ফেলতে পারে। তাই করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার পরও বাড়তি সতর্কতা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে থাকা আবশ্যক।

করোনা-পরবর্তী সম্ভাব্য জটিলতা
অনেক দেশেই ইতোমধ্যে বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী ভ্যাকসিনের আওতায় চলে এসেছে। বাংলাদেশেও ভ্যাকসিনেশন চলছে পুরোদমে। আর করোনা আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি সুস্থও হয়ে উঠছেন। তবে আক্রান্ত
রোগীদের অনেকেরই নতুন নতুন জটিলতায় ভুগতে হচ্ছে। ভাইরাসটি ফুসফুসসহ রোগীর হার্ট, কিডনি, লিভার, রক্ত সংবহনতন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই সুস্থ হওয়া, করোনা নেগেটিভ হওয়া কিংবা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মানেই সব ভোগান্তির অবসান নয়। করোনা থেকে সেরে ওঠার পর যে সমস্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো-

  • শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা।
  • করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও স্বাদ ও ঘ্রাণে সমস্যা হতে পারে।
  • কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
  • আগে থেকে হৃদযন্ত্রে সমস্যা না থাকলেও করোনা থেকে সেরে ওঠার পর হৃদরোগ দেখা দিতে পারে।
  • ত্বকে লাল দাগ বা র‌্যাশ উঠতে পারে।
  • হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের দুর্বলতা বা প্যারালাইসিস, ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা, স্পর্শ বা অনুভ‚তি লোপ পাওয়া, ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

  • ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ মারাত্মকভাবে বেড়ে যেতে পারে।
  • রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তনালির বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
  • হজমশক্তি কমে যেতে পারে। যার ফলে ঘন ঘন ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রিকজনিত পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • ঘুমের সমস্যার পাশাপাশি মানসিক অবসাদ বেড়ে যেতে পারে।
  • হাইপার-গ্লাইসিমিয়া তথা দেহে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
  • পোস্টভাইরাল ফ্যাটিগ সিনড্রোম। যেকোনো ভাইরাসজনিত অসুখ থেকে সেরে ওঠার পরই পোস্ট ভাইরাল ফ্যাটিগ সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। এসময় প্রচন্ড দুর্বল লাগা, ক্লান্তিবোধ হওয়া, মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, হাত-পা অবশ ভাব, মাংসপেশি, হাড় বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, কোমরে ও মেরুদন্ডে ব্যথা, অরুচি, অস্থিরতা, ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।

জটিলতা কমাতে করণীয়

  • করোনা থেকে সেরে উঠেই শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম বা হাঁটাচলা শুরু করবেন না। কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে অল্প পরিশ্রমের কাজ বা হাঁটাচলা দিয়ে আবার শারীরিক পরিশ্রম শুরু করা যেতে পারে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। সেইসঙ্গে বেশি করে শাক সবজি ও ফলমূল খেতে হবে। পোস্ট কোভিড পিরিয়ডে অনেকেরই খাবার গিলতে অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রে প্রথমে নরম ভাত, নরম খাবার দিয়ে খাদ্যাভ্যাস শুরু করা যেতে পারে।
  • নিয়মিত সাত-আট ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।সন্ধ্যার পর চা ও কফি পরিহার করুন। ঘুমের অসুবিধা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ সেবন করতে পারেন।
  • ধূমপান, মদ্যপান, তামাক বা তামাকজাতীয় দ্রব্য সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।
  • করোনা সংক্রমণপরবর্তী সময়ে শ্বাসকষ্ট ও কাশি থাকতে পারে।এসময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে পারেন।প্রয়োজনে ইনহেলারও ব্যবহার করতে পারেন। পাশাপাশি বাড়িতে পজিশনিং আর ব্রিদিং এক্সারসাইজ করুন।
  • মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকার চেষ্টা করুন।

করোনা-পরবর্তী এসব জটিলতা অল্প সংখ্যক মানুষেরই দেখা দেয়। এবং এগুলো খুবই সাময়িক। তবে নিজের কিংবা অন্য কারো এই ধরনের জটিলতা দেখা দিলে, খুব দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


ডা. মো: সাইদুল ইসলাম
এমবিবিএস, ডিটিসিডি, এমডি (চেস্ট), এফআরসিপি (গ্লাসগো)
এক্স. কনসালট্যান্ট, পালমোনারি ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন,
কিং সাউদ হাসপাতাল (কেএসএ)মেডিসিন,
এজমা ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, (রেসপিরেটরি মেডিসিন)
পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।

LinkedIn
Share
WhatsApp