কিডনির পাথর
মিশরের আল হামরা সমাধি ক্ষেত্র থেকে উদ্ধারকৃত ৭০০০ বৎসরের পুরাতন মমির মূত্র থলিতে পাথর পাওয়া গেছে। এই মমিটাই এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত সবচেয়ে পুরাতন পাথুরে রোগে আক্রান্ত মানুষ। সেই প্রাচীন মিশরে পাথুরে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর শল্য চিকিৎসা প্রয়োগের কোন পদ্ধতি জানা ছিল না বলে প্রতিয়মান হয়।

প্রাচীন ভারত বর্ষে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মূত্রতন্ত্রের পাথুরে রোগ সম্পর্কে জানা যায়। প্রাচীন গ্রীসের চিকিৎসা বিজ্ঞান ছিল উন্নত। হিপোক্রেটিসের বর্ণনায় কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের পাথর ও তার চিকিৎসা পদ্ধতি পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের পাথর চিকিৎসা বর্তমান আধুনিক অবস্থায় এসেছে। কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার কারণগুলো জটিল, মাল্টি ফ্যাকটোরিয়াল এবং এখনও বেশ স্পষ্ট নয়। ইউরিনারি স্টোনের উপাদান হচ্ছে কৃষ্টালয়েড ও অরগানিক ম্যাট্রিক্স। সাধারণত কিডনি বা মূত্রতন্ত্রে পাথর হলে ৭৫% রোগীর ক্ষেত্রে ব্যথা নিয়ে আসতে পারে। তীব্র ব্যথা হঠাৎ করে আরম্ভ হয় এবং এই ব্যথা মেরুদন্ডের পাশে বক্ষ খাচার নীচে অনুভূত হয়। এই ব্যথা পেটের সামনের দিকেও অনুভূত হতে পারে। এই ব্যথা পাথরের অবস্থানের তারতম্যের জন্য অনুভবের স্থানেরও তারতম্য হয়। পাথর উপর বা মধ্য ইউরেটারে থাকলে ব্যাথা কিডনি বরাবর জায়গা থেকে শুরু হয়ে পেটের নিচের দিকে অনুভূত হতে থাকে বা বাকাভাবে বিস্তৃত হতে পারে। পাথর ইউরেটারের নিচের দিকে থাকলে ব্যথা অনুভূত হয় এবং এই ব্যথা পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টিস বা অন্ডকোষে এবং স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে ল্যাবিয়া মেজরাতে অনুভূত হয়। পাথর ইউরেটার ও ইউরিনারি ব্লাডারের অন্তবর্তী স্থানে হলে ব্যথা অনেক সময় প্রোস্টাটাইটিস, সিসটাইটিস বা ইউরেথ্রাইটিস হিসেবে ভুল হতে পারে। কিডনিতে পাথর থাকার অন্য লক্ষণ হল রক্ত বর্ণ প্রস্রাব, প্রস্রাবের সাথে এই রক্ত যাওয়া কখনো কখনো খালি চোখে দেখা নাও যেতে পারে। ঘন ঘন প্রস্রাব, জ্বর বা প্রস্রাবের জ্বালা যন্ত্রনা নিয়ে অনেকে আসতে পারেন। প্রস্রাব পরীক্ষা, এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় সাহায্যে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। কিডনির পাথর চিকিৎসায় পাথরের আকার, আকৃতি ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে শরীরের বাইরে থেকে সকওয়েভ দিয়ে ভেঙ্গে বের করে আনা যায় কিংবা অস্ত্রোপচার করে পাথর বের করা যায়। ইউরেটারে বা মূত্রথলিতে পাথরের আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে প্রস্রাবের রাস্তার ভিতর দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে ভেঙ্গে বের করে আনা যায় বা অপারেশন করে বের করে আনা যায়। কিডনির পাথর চিকিৎসায় ব্যবহৃত উন্নতমানের প্রায় সকল চিকিৎসা পদ্ধতি বাংলাদেশ বিদ্যমান রয়েছে এবং বাংলাদেশের কৃতি ইউরোলজিস্টরা সাফল্যজনকভাবে এই সব চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ করছেন।

ESWL (Extra corporeal shock wave lithotripsy) এমন একটা পদ্ধতি যা দ্বারা শরীরের বাহির থেকে যন্ত্রের সাহায্যে সক ওয়েভ পাঠিয়ে পাথর ভেঙ্গে ফেলা হয়। এই পদ্ধতিতে পাথর ভাঙ্গার জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হয় তা হলো পাথরের উপাদান, আকার, অবস্থান ও ইউরেটারের পেটেন্সি। যদি অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাতজনিত রোগ থাকে বা গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে ESWL ব্যবহার করা যায় না, এ ছাড়াও UTI পাথরের নীচের দিকে ইউরেটার বন্ধ, কার্ডিয়াক পেসমেকার, রেনাল ফেইলিয়র বা সিসটিন স্টোনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।
PCNL বা PERCUTENEOUS NEPHROLITHOTOMY হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার সাহায্যে ENDOSCOPICযন্ত্রের সাহায্যে ছোট একটি ফুটো করে কিডনির পাথর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে বের করে নিয়ে আসা হয়। বড় পাথর, সিসটিন পাথর কিংবা যাদের ESWL করা যাচ্ছে না সেসব ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে রোগীর পিছনের দিক দিয়ে C-ARM মেশিনের সাহায্যে কিডনিতে ফুটো করে একটি টিউব বসিয়ে দেয়া হয। এই টিউবের মধ্যে দিয়ে নেফ্রোস্কোপ মেশিন ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এরপর মনিটরের পর্দায় পাথরটি দেখে লিথোট্রিপটর নামক অন্য একটি মেশিনের সাহায্যে পাথর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে যন্ত্রের সাহায্যে বের করে আনা হয়।
URS বা Uretero Renoscopy হচ্ছে আরেকটি আধুনিক পদ্ধতি যার সাহায্যে মূত্রনালীর ভিতর দিয়ে ইউরেটার এবং রেনাল পেলভিস সরাসরি দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে INTRACORPOREAL PNEUMATIC LITHOTRIPSY মেশিনের সাহায্যে ইউরেটারে পাথর বের করে আনা হয়।
প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে ইউরেটারে পৌছে সরাসরি মনিটরের পর্দায় ইউরেটারে পাথর দেখে তা ওঈচখ যন্ত্রের সাহায্যে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে বের করে নিয়ে আসা হয়। এ পদ্ধতিটি মিড এবং লোয়ার ইউরেটারিক ষ্টোনের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। আপার ইউরেটারিক স্টোনকে ঠেলে কিডনিতে পাঠিয়ে দিয়ে পরে ESWL করা যায়। অনেক সময় লোয়ার বা মিড ইউরেটারিক স্টোন ভাঙ্গার সময় কিডনিতে চলে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে পরে ESWL করে নিতে হয়।
কিডনিতে একবার পাথর হলে তা বার বার হতে পারে। তাই কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে এর পুনরাবৃত্তির হার কমিয়ে আনা যায়। সাধারণত যে সব এলাকায গরম বেশি সে সব জায়গায় লোকদের মধ্যে কিডনি পাথর বেশি দেখা যায়। এর কারণ হচ্ছে প্রধানত অতিরিক্ত গরমের ফলে শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়, ফলে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে শরীরবৃত্তির কার্যকারণে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই এসবক্ষেত্রে পানি বেশি খেতে হবে। পানি খাবার পরিমাণ খাদ্য গ্রহণের ৩ ঘণ্টার মধ্যে বেশি হতে হবে, যখন প্রচুর পরিশ্রম করা হয় তখনও পানি বেশি খেতে হবে, পানির পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবের পরিমাণ ৩ লিটার বা তার বেশি হয়। পৌনঃপুনিকভাবে যাদের কিডনিতে পাথর হয় তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে খাদ্যাভাস একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। প্রোটিন কিডনি দিয়ে ক্যালসিয়াম, অক্সালেট ও ইউরিক এসিডের নিঃসরণ বাড়ায়। এই এসিড কিডনি থেকে ক্যালসিয়াম শোষণ কমায়। এসব বিপাক ক্রিয়ার ফলে কিডনিতে পাথরের সম্ভবানা বেড়ে যায়। যাদের কিডনিতে বার বার পাথর হয় তাদেরকে দৈনিক প্রোটিন গ্রহণ বেশি না করা শ্রেয়।
ডায়াটরি ফাইবারে ফাইটিক এসিড থাকে যা অন্ত্রের ক্যালসিয়ামের সাথে যুক্ত হয়ে ক্যালসিয়ামের শোষণ কমিয়ে দেয়। ফাইবার যুক্ত খাদ্য যেমন গম, সয়া, চাউলের ভূসি স্টোন রিকারেন্স কমায়। যেসব খাদ্যে ক্যালসিয়াম ও অক্সালেট বেশি আছে যেমন দুধ, পানির ইত্যাদি রিকারেন্ট স্টোনের রোগীদের কম খাওয়া উচিৎ। অধিক লবণযুক্ত খাদ্য কিডনিতে পাথরের ঝুঁকি বাড়ায় তাই যাদের কিডনিতে বার বার পাথর হয় তাদের অধিক লবণযুক্ত খাদ্য কম খাওয়া ভাল। এছাড়াও যাদের কিডনিতে বার বার পাথর হয় তাদেরকে পাথর এনালাইসিস করে স্পেসিফিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

ডাঃ মুহাম্মদ হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, ইউরোলজি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়