কিডনি ও খাওয়া দাওয়া
সুস্থতার জন্য ওষুধের পাশাপাশি খাদ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। সে রকমভাবেই কিডনি রোগের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি খাদ্য তালিকা শুধু রোগীকে সুস্থ রাখবে তা নয়। এটি কিডনি রোগীর কিছু কিছু জটিলতা যেমন শরীরে পানির ভারসাম্যতা রক্ষা, উচ্চ রক্তচাপ, হাড়ের রোগ, ওজন হ্রাস থেকেও রক্ষা করবে।
রোগীর রোগের তীব্রতার উপর নির্ভর করে রোগীর পথ্য তৈরি করা হয়ে থাকে। তবে সাধারণভাবে কিডনি রোগে যে সমস্ত খাদ্যপ্রাণ (nutrients) বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা হলো-
- প্রোটিন
- ক্যালসিয়াম
- পটাসিয়াম
- সোডিয়াম
- পানি
এছাড়াও আয়রণ ও ক্যালরি খুবই প্রয়োজনীয় কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিডনি রোগীরা রক্ত স্বল্পতা ও অপুষ্টিতে (malnutrition) ভূগে থাকেন। কিডনি রোগীদের জন্য যে সমস্ত খাদ্য তৈরি হবে তাতে নিচের উপাদানগুলো কম পরিমানে থাকতে হবে।
- লবণ (সোডিয়াম)
- ফসফরাস
- ক্যালরিযুক্ত খাবার
- প্র্রোটিন
কিডনি রোগীর জন্য খাদ্য ডায়ালাইসিস শুরুর আগে ও পরে ভিন্ন হয়। এক নজরে চার্ট থেকে জেনে নেয়া যাক :
ডায়ালাইসিসের আগে ও পরে যে ধরণের খাবার খেতে হবে
ডায়ালাইসিসের আগে: প্রোটিন, সোডিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম নিয়ন্ত্রিত খাবার, সাধারণ ক্যালরিযুক্ত খাবার
ডায়ালাইসিসের পরে: উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার
কিডনি রোগীর খাদ্য
কিডনি রোগীর জন্য খাদ্য তালিকা তৈরিতে যে সমস্ত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলো
প্রোটিন আমাদের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য উপাদান কিন্তু কিডনি রোগীদের জন্য এই প্রোটিন, অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে রোগীর রক্তের ইউরিয়া পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। সেই জন্য নিয়ন্ত্রিত প্রোটিন গ্রহন করতে হবে।
উচ্চ প্রোটিন (Good Protin): মুরগি, মাছ, ডিম, দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার।
নিম্নমান প্রোটিন (Bad protin): ডাল ও ডাল জাতীয় খাবার, সয়া ও সয়া মিল্ক, যেকোনো ধরনের বিচি
ফসফরাস
ফসফরাস হলো এক ধরনের খনিজ (mineral) যা ক্যালসিয়ামের সঙ্গে হাড়, দাঁত গঠনে কাজ করে থাকে। কিডনি আমাদের শরীরর ফসফরাসের পরমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে বলে কিডনির যেকোনো সমস্যায় এই ফসফরাসের পরিমাণ আমাদের শরীরে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তাই কিডনি রোগীদের ফসফরাস নিয়ন্ত্রিত খাবার দেওয়া হয়ে থাকে।
বেশি ফসফরাসযুক্ত খাবার: কোমল পানীয়, পিনাট বাটার, পনির, গরু/মুরগীর কলিজা, বাদাম, আইসক্রিম
কম ফসফরাসযুক্ত খাবার: চাল, আটা, ব্রকলি, ক্যাপসিকাম
পটাশিয়াম: হৃৎপিণ্ডের জন্য পটাশিয়াম অতি প্রয়োজনীয় একটি খাদ্যপ্রাণ। কিন্তু কিডনি রোগীদের পটাশিয়ামের পরিমাণ শরীরে বৃদ্ধি পায় বলে পটাশিয়াম নিয়ন্ত্রিত খাবারের প্রয়োজন হয়।
বেশি পটাশিয়ামযুক্ত খাবার: গরুর মাংস, ফলের রস, শুকনা ফল, কলা, কমলা, ডাবের পানি, বাদাম
কম পটাশিয়ামযুক্ত খাবার: আপেল, নাশপাতি, আনারস, পেঁপে, চাল আটা
কিডনি রোগীর খাদ্যতালিকা
যেসব খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না
লবন, লবনযুক্ত খাবার, চিপস, আচার, কাঁচা সবজি, সালাদ, পালংশাক, পাটশাক, পুঁইশাক, মুলাশাক, কলমিশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ঢেঁড়স, টমেটো, সজনে, ডাল, ডাবের পানি, ফলের রস, কোমল পানীয়, হরলিক্স, মালটোভা, কফি, কেক, প্যাস্ট্রি, বাদাম, খেজুর, কিসমিস, গরু/খাসির মাংস, কলিজা, ডিমের কুসুম, গলদা চিংড়ি, মাছের ডিম, হাঁসের মাংস, শুটকি মাছ, ধূমপান, তামাক, পান, জর্দা, গুল, অ্যালকোহল ইত্যাদি।
যেসব খাদ্য গ্রহণ করা যাবে
সকল খাবারে সামান্য লবন, সিদ্ধ সবজি, লাউ, চিচিংগা, ঝিংগা, কুরল্লা, শশা, চাল কুমড়া, বেগুন, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি, আনারস, পেঁপে, কুসুমবিহীন ডিম, মাছ, মুরগীর মাংস (চামড়া বাদে), সূর্যমূখী বীজের তেল, সয়াবিন তেল, ননীবিহীন দুধ ইত্যাদি।
সোডিয়াম
আমাদের শরীরের পানির ভারসাম্য রক্ষায় সোডিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ কিডনি অতিরিক্ত সোডিয়াম শরীর থেকে বের করে দেয় কিন্তু কিডনির কোন সমস্যায় কিডনি তা পারে না বলে সোডিয়াম নিয়ন্ত্রিত খাবার দেওয়া হয়ে থাকে।
উচ্চ সোডিয়ামযুক্ত খাবার
খাবার লবণ, আলুর চিপস, সলটেড বিস্কুট, পনির, বাদাম, টিন জাতীয় খাবার, আচার, ফাস্ট ফুড।
পানি ও পানীয়
কিডনি আমাদের শরীরের পানির পরিমাণ ঠিক রাখে। কিডনির সমস্যায় কিডনি পানির ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না বলে কিডনি রোগীদের জন্য পানি বা পানীয় জাতীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয়।
পানি ও পানীয় জাতীয় খাদ্য হলো- চা বা কফি, স্যুপ, আইসক্রিম, দুধ ও পানি।
শর্করা
ক্যালরির প্রধান উৎস হল শর্করা। তবে অতিরিক্ত ওজন বা ডায়াবেটিকস থাকলে শর্করা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়।
ফ্যাট
ফ্যাট ক্যালরির জন্য ভাল উৎস। তবে ফ্যাটের জন্য আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যেমনঃ সয়াবিন তেল, অলিভ অয়েল ইত্যাদি ব্যবহার করা উচিত। কারণ এই সমস্ত ফ্যাট রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
আয়রণ ও ক্যালশিয়াম
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কিডনি রোগীরা রক্ত স্বল্পতা বা হাড়ের সমস্যায় ভূগে থাকে। সেই জন্য কিডনি রোগীদের খাবারে আয়রণ ও ক্যালসিয়াম যোগ করার প্রয়োজন হয়ে থাকে।
কিডনি ভাল রাখার জন্য
কিডনি আমাদের শরীরের ছাকনির কাজ করে। ৩০-৪০ বছর বয়সের পর থেকে কিডনির কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে প্রায় ১০%। সেই জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে কিডনিকে ভালো রাখা যেতে পারে।
- ডায়াবেটিস, উচ্চরক্ত চাপ এবং হৃদরোগ নিয়ন্ত্রনে রাখা।
- খাবারে সামান্য লবণ ও কাঁচা লবন সম্পূর্ণ বর্জন করা।
- বেশি পরিমানে পানি (৮-১০ গ্লাস দিনে) পান করা।
- খাদ্যাভাস পরিবর্তন করা।
- স্বাস্থ্যকর পানীয় (ফলের রস, ডাবের পানি) পান করা।
- অ্যালকোহল ও ধূমপান বর্জন করা।
- সাধারণ শরীরচর্চা এবং প্রতিদিন ৩০ -৪৫ মিনিট হাঁটা।
- ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত ওষুধ সেবন না করা।
- নিয়ন্ত্রিত জীবন, খাদ্যাভাস পরিবর্তন, অতিরিক্ত ওজন কমানোর মাধ্যমে আমরা আমাদের কিডনিকে ভালো রেখে সুস্থ থাকতে পারি।
সালমা পারভীন
নিউট্রিসনিস্ট