কিডনি ও শল্য চিকিৎসা

কিডনি ও শল্য চিকিৎসা

শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রতঙ্গের মত কিডনি ও মূত্রতন্ত্র বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে, কোনো কোনো সময় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনও হয়। তবে অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য, অন্যান্য রোগের উপস্থিতি ইত্যাদি বিবেচনায় আনা দরকার। অনেক সময় অপারেশন না করেও রোগীকে সুস্থ রাখা যায়। তবে এ পরিস্থিতিতে একজন ইউরোলজিস্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কখন এবং কি অপারেশন করা দরকার। নিচে স্বল্পপরিসরে পর্যায়ক্রমে সমস্যা গুলো আলোচনা করা হলো।

কিডনি ও শল্য চিকিৎসা

পাথুরে রোগ

মূত্রতন্ত্রের পাথর সাধারণত কিডনি, ইউরেটার, মূত্রথলি ও মূত্রনালীতে হয়ে থাকে। প্রস্রাবের সাথে বের হওয়া বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, যেগুলো সাধারণত প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায় সেগুলো জমাট বেঁধে এই পাথরগুলো তৈরি হয়। কিডনি ও ইউরেটারে পাথর হলে পিঠ ও পেটের ব্যথা এবং মূত্রথলিতে পাথর হলে তলপেটে ব্যথা হয়। এছাড়া প্রস্রাবের সাথে রক্ত বা পাথর কনা বের হতে পারে, জ্বরও হতে পারে। পাথরের অবস্থান ও আকৃতিভেদে বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। কিডনি ও ইউরিনারি পাথর চিকিৎসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় ধরণের কাটা ছেড়া করা হয় না। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে এখন কাটাছেড়া করা ছাড়াই বিভিন্নভাবে কিডনি পাথরের চিকিৎসা সম্ভব। সংক্ষেপে কয়েকটি বহুল প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নিন।

ESWL (Extra corporeal shock wave lithotripsy) একটি পরীক্ষিত প্রচলিত পদ্ধতি যাতে সকওয়েভ ব্যবহৃত হয়। শক্তিশালী সকওয়েভ শরীরের বাহির থেকে মেশিনের সাহায্যে পাঠানো হয় যা পাথরে আঘাত করে পাথরকে ছোট ছোট টুকরা করে দেয়। পরবর্তীতে টুকরোগুলো প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে পাথর ভাঙ্গার পূর্বে কিডনি থেকে মূত্রথলিতে কৃত্রিম নল (Stent) স্থাপন করার প্রয়োজন হয়। লিথোট্রিপসি টেবিলে C-Arm সম্বলিত X-ray এর সাহায্যে পাথর চিহ্নিত করা হয় এবং প্রয়োজনীয় মাত্রার সকওয়েভ প্রদান করা হয়।

PCNL (Percutaneous Nephrolithotomy) যখন পাথরের অবস্থানের কারণে ESWL ব্যবহার যুক্তিযুক্ত না হয় কিংবা পাথরের আকার বড় হয় তখন PCNL পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে ছোট একটি ছিদ্র করে কিডনি বরাবর একটি পথ তৈরি করা হয়। ঐ Nephroscope নামে একটি যন্ত্রের মাধ্যমে পাথরের অবস্থান জেনে তা দূর করা হয়। রোগীকে হাসপাতালে অল্প কয়েক দিন থাকতে হয়।

URS and ICPL এই পদ্ধতিতে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে বাহির থেকে শলাকার ন্যায় যন্ত্র, (ureteroscope) দিয়ে মূত্রপথ,  মূত্রথলি, মূত্রনালী হয়ে কিডনী পর্যন্ত যে কোনো স্থান ভিডিও মনিটরে দৃষ্টি গোচর করা যায়। এরপর খুবই সরু শলাকা সম্বলিত নিউম্যাটিক লিথট্রিপটর নামক যন্ত্র দিয়ে পাথরে আঘাত করে পাথর গুড়ো করা হয়, বড় বড় টুকরোগুলো খুবই ছোট  একটি ফরসেপ অথবা বাস্কেট দিয়ে বের করে আনা হয়। এ কাজে এখন নিউম্যাটিক লিথট্রিপটর এর জায়গায় অনেক সময় লেজার ব্যবহার হচ্ছে।

কিডনি ও মূত্রথলির টিউমার : পিঠ বা পেটের একপাশে ব্যথা, তলপেটে ব্যথা, প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া এই রোগের প্রধান লক্ষণ। প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হওয়া উপসর্গটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত এবং অনতিবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে টিউমারের আকার ও অবস্থান নির্ণয় করা হয়। মূত্র পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড, IVU, CT, MRI এর মত পরীক্ষা দ্বারা কিডনি, মূত্রনালী অথবা মূত্রথলির টিউমার এর আকার, অবস্থান, ব্যাপ্তি নির্ণয় করা যায়। সময় মতো রোগ ধরা পড়লে অপারেশন, কেমোথেরাপী ও রেডিওথেরাপীর মাধ্যমে সুস্থতালাভ করা যায়।

প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি : পুরুষদের মূত্রথলি থেকে প্রস্রাব নির্গমনের পথের চারদিক ঘিরেই প্রোস্টেট গ্রন্থির অবস্থান। এটি বীর্যরস সরবরাহ করে। বৃদ্ধ বয়সে এই  প্রোস্টেট গ্রন্থি বৃদ্ধি পেয়ে প্রস্রাব নির্গমনে বাঁধা প্রদান করে রোগের সৃষ্টি করে। এই রোগের লক্ষণগুলো হলো- ঘন ঘন প্রস্রাব, রাতে ঘুম ভেঙ্গে প্রস্রাব করতে উঠা, সরুনলে থেমে থেমে প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাব পূর্ণভাবে ক্লিয়ার না হওয়া। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারন করা হয়। বিগত দুই দশকে লেজার রশ্মির বিভিন্ন ব্যবহার এর মাধ্যমে প্রোস্টেট গ্রন্থি বৃদ্ধির চিকিৎসা করা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে মাইক্রোওয়েভ হাইপারথার্মিয়া, হাই-ইনটেনসিটি ফোকাস্ড আল্ট্রাসাউন্ড ইত্যাদি নানা রকম চিকিৎসা।

প্রোস্টেট গ্রন্থিতে ক্যান্সার : সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও আমাদের দেশে প্রোস্টেট ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব যথেষ্ট বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসা BPH থেকে একেবারেই ভিন্ন। প্রোস্টেট ক্যান্সারের অপারেশন ও অপারেশনের সিদ্ধান্ত বা অন্যান্য চিকিৎসা নির্ভর করে অনেক কিছুর উপর। টিস্যু পরীক্ষা করে প্রোস্টেট ক্যান্সার ও এর গ্রেড নির্ণয় করা হয়। তারপর CT স্ক্যান, MRI এবং Bone Scan জাতীয় পরীক্ষা দ্বারা প্রোস্টেট ক্যান্সার এর স্টেজ নির্ণয় করা হয়। প্রোস্টেট ক্যান্সার যা গ্রন্থির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং যাদের বয়স অপেক্ষাকৃত কম, অর্থাৎ যাদের ১০ বৎসর এর বেশি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে, তাদের অপারেশন অথবা রেডিওথেরাপি দ্বারা ক্যান্সার নির্মূল করা সম্ভব।

মূত্রনালীর স্ট্রিকচার : গনোরিয়া জাতীয় ইনফেকশনের কারনে বা সরাসরি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এই রোগ হয়। মূত্রনালী সরু হয়ে মূত্রপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। সরুনলে ধীরগতিতে প্রস্রাব হয়।  প্রস্রাব শেষে মূত্রথলিতে প্রস্রাব জমে থাকে। সময় মতো চিকিৎসা না করলে জমে থাকা প্রস্রাব উপরে ইউরেটার এমনকি কিডনিতে চাপ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শরীরের অন্য জায়গা, বিশেষ করে মুখগহŸরের ভিতর থেকে অল্প পরিমান চামড়া এনে মূত্রনালীতে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এটি বেশ একটি কার্যকারী পদ্ধতি (Substitution Urethroplasty) তবে অনেক সময় মূত্রনালীর সরু অংশ কেটে বাদ দিয়ে ভালো অংশ জোড়া দেয়া হয় (Anastomotic urethroplasty)

জন্মগত বিকলাঙ্গতা : শরীরের অন্য অংশের মতো মূত্র ও জননতন্ত্রের বিকলাঙ্গতা নিয়ে অনেক শিশু ভূমিষ্ঠ হতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থানের নিচে বা উপরে মূত্রদ্বারের অবস্থান (Hypospadias/ Epispadias), পেটের বাইরে মূত্রথলির অবস্থান (Bladder exstrophy), অন্ডকোষের বিরূপ অবস্থান জাতীয় অসুবিধাগুলি জন্মের সাথে সাথেই ধরা পড়ে। অন্য অসুবিধাগুলি যেমন মূত্রনালীতে ভালভ, কিডনি ইউরেটারের সংকোচিত সংযোগ, ইউরেটার মূত্রথলির সংকোচিত সংযোগ, মূত্রথলি হতে প্রস্রাব উল্টো পথে ইউরেটারে প্রবাহ ইত্যাদি রোগ সমূহ উপসর্গ তৈরি করার পরেই ধরা পড়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর উপযুক্ত অস্ত্রপচার করে রোগের চিকিৎসা করা যায়।

পুরুষদের যৌন ও প্রজনন অক্ষমতা (বন্ধাত্ব) : যৌন অক্ষমতার প্রধান কারণগুলো হলো মানসিক, স্নায়বিক ও রক্তসঞ্চালনের অসুবিধা। সঠিক এবং বিজ্ঞান সম্মত যৌনজ্ঞানের অভাবই মানসিক যৌন অক্ষমতার কারণ। অতিরিক্ত মদ্য ও ধূমপান, ডায়াবেটিস, জননেন্দ্রিয়ের রক্তনালীর অসুবিধা অথবা অজ্ঞাত কারণের জন্য যৌন অক্ষমতা দেখা দেয়। পরীক্ষার মাধ্যমে অক্ষমতার কারণ নির্ণয় করে ওষুধ সেবন করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সক্ষম হয়ে উঠে। কোন কিছুই কাজ না হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয় (Penile Prosthesis)|

পুরুষ বন্ধ্যাকরণ অপারেশনে প্রজনন ক্ষমতা হারানো ব্যক্তিও অপারেশনের মাধ্যমে পুনরায় প্রজনন ক্ষমতা ফিরে পেতে পারে (Vas recanalisation)| এ ছাড়া সরাসরি সুক্ষ সূচ দিয়ে অন্ডকোষ থেকে শুক্রানু সংগ্রহ করা যায়। যা কিনা পরে টেষ্টটিউব বেবি গঠন প্রক্রিয়ায় কাজে লাগানো হয়।

অন্ডকোষ পাক খাওয়া : জন্মগত ভাবে ত্র“টি থাকলে বা শীতের সময় শিশু থেকে শুরু করে যুবক বয়স পর্যন্ত যেকোনো সময়ে অন্ডকোষ পাক খেতে পারে। অন্ডকোষ পাক খেলে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয় সাথে অন্ডকোষ ফুলে যেতে পারে। পাক খাওয়ার কারণে অন্ডকোষে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অন্ডকোষ দ্রুত নষ্ট হতে পারে। পরীক্ষা করে সময় নষ্ট না করে, এ ধরণের  রোগীদের দ্রুত ৫/৬ ঘণ্টার মধ্যেই অস্ত্রোপচার করে অন্ডকোষ এর পাক ঘুরিয়ে দুদিকের অন্ডকোষই কয়েক জায়গায় বেঁধে দিতে হয়। যাতে ভবিষ্যতে আর পাক খেতে না পারে। অস্ত্রোপচার এ দেরী হলে অন্ডকোষ নষ্ট হয়ে যায়। অন্ডকোষ তখন কেটে ফেলতে হয়। তাই শিশুদের অন্ডকোষে ব্যথা হলে দ্রুত হাসপাতাল নেয়া দরকার। একজন দক্ষ চিকিৎসক এর পরামর্শ নেয়া দরকার।


ডা. জাহাঙ্গীর কবির

এফআরসিএস, এফসিপিএস, এমবিবিএস
ইউরোলজিস্ট ও এন্ড্রোলজিস্ট
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp