কিডনি ক্যানসার
জনাব মোহাম্মদ আলী (ছদ্মনাম) পেশায় ছিলেন শিক্ষক। বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। বয়স ৭০ বছর। শারীরিক বিবেচনায় সুস্থই ছিলেন। যদিও উচ্চরক্তচাপের জন্যে চিকিৎসা নিচ্ছেন গত ১০ বছর। এখন থেকে ৩ বৎসর পূর্বে হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করেন প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাচ্ছে। ব্যথা বেদনাহীন রক্তমিশ্রিত প্রস্রাব। প্রাথমিক পর্যায়ে একটু ভীত বিব্রত হলেন। জানালেন নিকটজনদের। শরণাপন্ন হলেন স্থানীয় একজন চিকিৎসকের। চিকিৎসকের পরামর্শে একটি অ্যান্টিবায়োটিক, সাথে অধিকমাত্রায় পানি পান করলেন। ১-২দিন পরে প্রস্রাব পরিস্কার হলো। ভাবলেন বন্ধ হলো রক্তপাত। কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গেলেন না। ৭-১০ দিনের মাথায় আবার লাল রক্তমিশ্রিত প্রস্রাব। হাজির হলেন পূর্বের ঐ চিকিৎসকের কাছে। এবার ঐ চিকিৎসক জানালেন আপনার একজন ইউরোলজি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। মোহাম্মদ আলী দেরি না করে সোজা এলেন ইউরোলজিস্ট এর কাছে। এই ইউরোলজিস্ট এক সময় তার ছাত্র ছিল। এবার ইউরোলজিস্ট চিকিৎসক তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেন। পরীক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে পাওয়া গেল মোহাম্মদ আলী সাহেবের ডান কিডনিতে একটা টিউমারের উপস্থিতি। কিডনির কাজ করবার ক্ষমতা স্বাভাবিক আছে দেখে CT Urography সহ আরো কিছু পরীক্ষা করালেন চিকিৎসক। নিশ্চিত হলেন মোহাম্মদ আলী সাহেবের অসুস্থতা সম্পর্কে। টিউমারটি এখনও কিডনির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। ইউরোলজিস্ট তার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষককে এ রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। বিস্তারিত জেনে মোহাম্মাদ আলী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি চিকিৎসায় যাবেন। অতঃপর চিকিৎসা হলো।
গত তিন বৎসর মোহাম্মদ আলী তিন মাস, ছয় মাস পরপর ফলোআপ করে যাচ্ছেন। চিকিৎসা পরবর্তীকালে তিনি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। এখনও উচ্চরক্তচাপের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন তবে পরিমানে কম লাগছে। স্বাভাবিক খাবার, চলাফেরাসহ প্রতিদিনের কাজ নিজে করছেন। মোহাম্মদ আলী সাহেবের মন্তব্য ‘আমি ভাবতেই পারিনি কিডনি ক্যানসার হবার পরে চিকিৎসা নিয়ে এতো ভাল থাকা যায়। তবে যে সবাই বলে ক্যানসার চিকিৎসায় লাভ হয় না। এ কথাতো দেখছি ঠিক না।
এ কথাটা সবার জানা দরকার। কিডনি ক্যানসার হয়েছে জেনেই হতাশায় ডুবে যাবার কোন মানে নেই। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাই বোধকরি প্রয়োজন।
হ্যাঁ পাঠক, এটাই সত্য। কিডনিতে টিউমার-ক্যানসার হতেই পারে। আর মোহাম্মদ আলী সাহেবের মতো অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে প্রায় সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
কিডনিতে টিউমার হলেই কি তা ক্যানসার?
কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। তবে প্রায় শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ কিডনির সলিড টিউমার ক্যানসার জাতীয়। তাই কিডনিতে টিউমারের উপস্থিতি পাওয়া গেলে তাকে ক্যানসার হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত যতক্ষণ অন্য কিছু হিসেবে রোগ নির্ণয় (Diagnosis) করা না যাচ্ছে।
কত বয়সে হয় কিডনিতে ক্যানসার?
যে কোন বয়সেই হতে পারে। তবে সিংহভাগ কিডনি ক্যানসার হয় পরিনত বয়সে ৬০ বৎসরের উর্ধ্বে। সাধারণত ৪০ বছরের পর থেকে এ প্রবণতা বাড়তে থাকে।
ছোট বাচ্চাদের কিডনি
ক্যানসার হয় না?
হতে পারে। সাধারণত শিশুদের Wilm’s Tumour নামক এক বিশেষ ধরনের কিডনি টিউমার হয়। যা পূর্ণ বয়স্কদের কিডনি ক্যানসার থেকে একটু ভিন্ন।
কি কি কারণে কিডনি ক্যানসার হয়?
- যাদের বয়স ৬০ এর উপর
- যারা ধূমপান করেন
- ওজন বেশী
- যারা উচ্চরক্ত চাপে ভূগছেন
- যাদের নিকট আত্মীয়দের কিডনি ক্যানসার হবার ইতিহাস রয়েছে
- যে সকল রোগী দীর্ঘদিন ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন
- কিছু জেনেটিক অসুখের কারণে
কিডনি ক্যান্সারের উপসর্গ কি কি?
পায় ৭০ শতাংশ কিডনি ক্যান্সারের রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ে কোন উপসর্গ থাকে না। কারো কারো পেটের উপরিভাগে বক্ষ পিঞ্জরের নীচে চাকা অনূভূত হয়। এ ছাড়া কিডনি ক্যান্সারের রোগীরা—
- প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া
- কাশিতে রক্ত
- বুকে ব্যথা
- হাড়ের ব্যথা
- জন্ডিস
- রক্ত শূণ্যতা
- উচ্চ রক্তচাপ
- ওজন কমে যাওয়া
- অতিরিক্ত দূর্বলতাসহ নানা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন।
কিডনি ক্যানসার নির্ণয় বা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় (Diagnosis) করা যায় কি উপায়ে?
- চিকিৎসক রোগীর পূর্ণ ইতিহাস জেনে নেবেন।
- চিকিৎসক রোগীকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করবেন।
- কিছু প্রাথমিক ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করতে হবে।
- কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের আল্ট্রাসনোগ্রাম
- প্রস্রাবের অনুবীক্ষন যন্ত্রের সাহায্য পরীক্ষা (Routine Microscope Examination)
- রক্তে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ জেনে নিতে হবে।
কিছু বিশেষ ল্যাবরেটরী পরীক্ষা কিডনি ক্যানসার নিশ্চিত হতে ও তার বিস্তৃতি সম্পর্কে জানতে করা প্রয়োজন হয়।
- CT Scan KUB/CT Urography
- FNAC of tumour
- CT Chest/X-ray Chest
- Liver Function test
- Radio isotope bone Scan
কিডনি ক্যান্সারের চিকিৎসা কি?
শৈল্য চিকিৎসা (Surgery) হচ্ছে কিডনি ক্যান্সারের মূল চিকিৎসা। কিডনি ক্যানসার সাধারণত Chemotherapy resistant, Chemotherapy দিয়ে কাঙ্খিত ফল লাভ প্রায় অসম্ভব। কিডনি ক্যান্সারে Chemotherapy দিয়ে চিকিৎসায় ও ভাল ফল লাভ করা যায় না। Targeted Radiotherapy এ চিকিৎসায় এটি নতুন সংযোজন এবং সম্ভাবনাময়।
অন্য সকল ক্যান্সারের ন্যায় কিডনি ক্যান্সারের চিকিৎসাও প্রাথমিক পর্যায়ে করা গেলে চমৎকার ফললাভ সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় নিরাময় লাভ সম্ভব।
কিডনি ক্যানসার-টিউমার চিকিৎসার পরিকল্পনা বা পদ্ধতি নির্ধারণ কি করে করা হয়?
কিডনি ক্যান্সারের ধরন, বিস্তৃতি, রোগীর বয়স, হৃদযন্ত্র, ফুসফুসের অবস্থা বিবেচনা করে সাধারণত ইউরোলজিস্ট এ সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে বা প্রয়োজনে ইউরোলজিস্ট, অনকোলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট যৌথভাবে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
অধ্যাপক ডা. কাজী রফিকুল আবেদীন
ইউরোলজিষ্ট এন্ড এ্যান্ড্রোলজিষ্ট
সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজস এন্ড ইউরোলজি।