কেন হয় ফ্রোজেন শোল্ডার

সকালে ঘুম থেকে উঠে মাহবুবুর রহমান খেয়াল করলেন, তার কাঁধে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। ঘাড় নাড়াতে পারছেন না। এদিক-ওদিক তাকানোর জন্য পুরো শরীর ঘোরাতে হচ্ছে। হাত-মুখ ধুতে গিয়ে দেখলেন, হাত নাড়ানো যাচ্ছে না। অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে লক্ষ করলেন, চুল আঁচড়াতে কষ্ট হচ্ছে। পেছনের পকেটে মানিব্যাগ রাখতে গিয়েও ব্যথা পাচ্ছেন।

মাহবুবুর রহমানের এই সমস্যাটিকে বলা হয় ‘ফ্রোজেন শোল্ডার’। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়—অ্যাডহেসিভ ক্যাপসুলাইটিস। এতে কাঁধে ব্যথা হয়, কাঁধ শক্ত হয়ে যায় বা জমাট বেঁধে যায়। কাঁধ নাড়াচাড়া করতে অসুবিধা হয়।

কেন হয় ফ্রোজেন শোল্ডার

ফ্রোজেন শোল্ডার হওয়ার কারণ

ঘাড় ও বাহুর সংযোগস্থলে কাঁধের যে সন্ধি তাকে শোল্ডার জয়েন্ট বলে। এই জয়েন্টের ব্যথাই মূলত ফ্রোজেন শোল্ডার। নানা কারণে এ ব্যথা হতে পারে। যেমন—

  • সংক্রমণ
  • টিউমার
  • হাড়ক্ষয়
  • লিগামেন্টে আঘাত বা ছিঁড়ে যাওয়া
  • ডায়াবেটিস, স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক
  • পক্ষাঘাত বা অন্য কোনো রোগে দীর্ঘদিন সন্ধি অকার্যকর থাকা।

শোল্ডার জয়েন্টে সাইনোভিয়াল ক্যাপসুল নামক একটি পর্দা থাকে। এর ভেতরে থাকে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড নামক একধরনের তরল পদার্থ। উপরের যেকোনো কারণে জয়েন্ট আক্রান্ত হলে এই তরল পদার্থ ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। তখন সাইনোভিয়াল ক্যাপসুল-পর্দা সংকুচিত হয়ে যায় এবং শোল্ডার জয়েন্ট জমে শক্ত হয়ে যায়।

ফ্রোজেন শোল্ডার দীর্ঘস্থায়ী 
হলে কাঁধের মাংসপেশি 
শুকিয়ে যেতে পারে।

যাদের ঝুঁকি বেশি

সাধারণত ৪০—৬০ বছর বয়সীদের এই রোগে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। যাদের ডায়াবেটিস আছে অন্যদের চেয়ে তাদের ঝুঁকি বেশি। হৃদরোগ, স্ট্রোক বা থাইরয়েডে ভুগছেন যারা তারা এতে সহজেই আক্রান্ত হতে পারেন। স্থূলদেহী ব্যক্তিরাও ফ্রোজেন শোল্ডারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। দীর্ঘদিন ভারী কাজ করার অভ্যাস নেই যাদের, হুট করে ভারী কোনো কাজ করলে তারা এতে আক্রান্ত হতে পারেন। কোনো কারণে কাঁধের নড়াচড়া কম হলে এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

সাধারণত ব্যথার মধ্য দিয়ে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা যেমন বাড়ে, তেমনই কাঁধের নড়াচড়া সীমিত হতে থাকে। ফ্রোজেন শোল্ডারের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো নিম্নরূপ—

কেন হয় ফ্রোজেন শোল্ডার
  • কাঁধ শক্ত হয়ে যাওয়া।
  • হাত ও কাঁধের অস্থিসন্ধির ব্যথার পাশাপাশি হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া।
  • ঘাড় এদিক-সেদিক ঘোরাতে না পারা।
  • আক্রান্ত পাশে ফিরে শুতে না পারা।
  • হাত ওপরে তুলতে, পেছনে নিতে বা নাড়াচাড়া করতে অসুবিধা হওয়া।
  • পিঠ চুলকানো, চুল আঁচড়ানোর মতো কাজগুলো করতে সমস্যা হওয়া।
  • হাত দুর্বল হয়ে যাওয়া।
  • হাত দিয়ে কিছু বহন করতে না পারা।
  • প্রার্থনার সময় শরীর নাড়াতে না পারা।

রোগ নির্ণয়

ইতোমধ্যে আমরা বুঝতে পেরেছি, ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে বিভিন্ন কারণে। যথাযথ চিকিৎসার জন্য রোগের কারণ নির্ণয় করা জরুরি। এক্ষেত্রে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার হতে পারে। যেমন—

  • রক্ত পরীক্ষা
  • শোল্ডার জয়েন্টের এক্স-রে
  • শোল্ডার জয়েন্টের আলট্রাসনোগ্রাম
  • শোল্ডার জয়েন্টের এমআরআই

চিকিৎসা

ফ্রোজেন শোল্ডার খুবই অস্বস্তিদায়ক সমস্যা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয়। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি আপনা আপনিই ভালো হয়ে যায়, তবে কখনো কখনো দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যেতে পারে। এমনকি মাস পেরিয়ে বছরজুড়েও ভুগতে হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেলে অন্যান্য ঝুঁকি তৈরি হয়। কাঁধের মাংসপেশি শুকিয়ে গিয়ে বড়ো ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। ফ্রোজেন শোল্ডার নিরাময়ে নিম্নোক্ত নির্দেশনাগুলো মেনে চলবেন—

  • চিকিৎসকের দেখিয়ে দেওয়া নিয়মানুযায়ী কাঁধের ব্যায়াম করতে হবে।
  • প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি নিতে হবে।
  • গরম বা ঠান্ডা সেঁক নেওয়া যেতে পারে।
  • ডায়াবেটিস, থাইরয়েড থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • যে পাশে সমস্যা সে পাশ ফিরে শোবেন না।
  • ভারী জিনিসপত্র বহন করবেন না বা নিচ থেকে ওপরে তুলবেন না।
  • ব্যথা বেশি হলে বা কাঁধ বেশি মাত্রায় শক্ত হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
  • দৈহিক ওজন বেশি হলে কমিয়ে ফেলুন।

মনে রাখবেন, রোগটি মোটামুটি দীর্ঘমেয়াদি। পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। তাই ধৈর্য ধরে এর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।


ডা. এম সাইফুদ্দিন

ডা. এম সাইফুদ্দিন

এমবিবিএস (ডিএমসি), বিসিএস (স্বাস্থ্য), এফসিপিএস (মেডিসিন)
এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি) বারডেম, এফআরসিপি (আয়ারল্যান্ড), এফআরসিপি (গ্লাসগো), এফআরসিপি (এডিনবার্গ),
এফএসিই (ইউএসএ), এফএসিপি (ইউএসএ),
এফআরএসএম (ইউকে). ট্রেনিং ইন অ্যাডভ্যান্স এন্ডোক্রাইনোলজি (সিঙ্গাপুর, মায়ো ক্লিনিক ইউএসএ), ফেলোশিপ ট্রেনিং
(হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল)
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রাইনোলজি)
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, হরমোন ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

LinkedIn
Share
WhatsApp