কোমরে ব্যথার যত কারণ

-অধ্যাপক ডা. আবু জাফর চৌধুরী বিরু

ঘটনা-০১
মারিয়া হোসেন, বয়স চল্লিশ বছর। পেশায় একজন ব্যাংকার। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি চেয়ারে বসে কাজ করেন। শারীরিক পরিশ্রম খুব একটা করেন না। আজকাল তিনি প্রায়ই কোমরব্যথায় ভুগছেন। বসতে গেলে কোমরে ব্যথা পান। আবার অনেকক্ষণ কাজ করে চেয়ার ছেড়ে উঠতেও তীব্র ব্যথা দেখা দেয়।

ঘটনা-০২
ক্লাস নাইনে পড়ুয়া আবিরকে নিয়ে তার মা হাসপাতালে এসেছেন। কোমরব্যথায় ভুগছে আবির। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, বাড়িতে সে কীভাবে পড়াশোনা করে। উত্তরে আবির জানায়, সে টেবিল–চেয়ারে পড়ার চেয়ে বিছানায় বসে বা হেলান দিয়ে পড়তে বেশি পছন্দ করে। এভাবেই সে পড়াশোনা করত সবসময়।

কোমরে ব্যথার যত কারণ

ব্যথার সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে কোমরব্যথা। যেকোনো বয়সেই কোমরব্যথা হতে পারে। বলা হয়, শতকরা নব্বই শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো সময় কোমরব্যথায় ভোগেন। কোমরে ব্যথা হয় সাধারণত পেশি ও হাড়ের ভারসাম্যহীনতার কারণে। শারীরিক পরিশ্রম কম করার ফলে পেশি দুর্বল হয়ে যায়। এই দুর্বলতার জন্য হাড়ের মাঝের ডিস্কের স্নায়ুতে চাপ পড়ে। সঠিক চিকিৎসা ও সচেতন চলাফেরার মাধ্যমে বেশিরভাগ রোগী দুই মাসের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যায়।

যেসব কারণে কোমরব্যথা হতে পারে

আমাদের মেরুদণ্ডের হাড়গুলোর মাঝে কিছু বিশেষ ধরনের ডিস্ক বা চাকতি থাকে। কোনো কারণে এই চাকতি সরে গেলে পিঠ ও কোমরে ব্যথা হয়। ব্যথার পাশাপাশি কোমর, নিতম্ব ও পায়ে ঝিমঝিম বা খচখচ করা, অনুভূতি না পাওয়া, এমনকি দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোমরব্যথার পেছনে নির্দিষ্ট একটি কারণ থাকে না। পেশি ও লিগামেন্টে হঠাৎ টান বা চাপ লাগলে কোমরব্যথা হতে পারে। মেরুদণ্ডের ক্ষয়, স্পন্ডাইলোসিস, ডিস্ক হার্নিয়েশন, গাউট, স্পাইনাল ক্যানেল, আর্থ্রাইটিসসহ নানান কারণে কোমরব্যথা হতে পারে। এছাড়াও যেসব কারণে কোমরব্যথা হতে পারে—

  • বয়স বা বংশগত কারণে কোমরের হাড় ক্ষয় হলে
  • মেরুদণ্ডে টিউমার বা ইনফেকশন হলে
  • অতিরিক্ত ওজনের কারণে
  • বসার ভঙ্গি ঠিক না হলে ও চেয়ারের কাঠামোগত ত্রুটি থাকলে
  • আঘাতজনিত কারণে
  • বসে কাজ করার সময় সামনে-পিছনে ঝুঁকে কাজ করলে
  • গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানোর সময় ঝুঁকে বসলে
  • ভারী জিনিস ওঠানামা করতে সঠিক নিয়ম না মানলে
  • শুয়ে বা কাত হয়ে বই পড়লে বা কাজ করলে

কোমরব্যথার বিপৎসংকেত

কোমরব্যথা স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এক মাসের কম সময় ধরে ব্যথা থাকলে সেটি স্বল্পমেয়াদি। এক মাসের বেশি হলে সেটি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক ব্যথা। কোমরব্যথা ভোগায় খুব। তবে এতে কেউ মারা যায় না। ব্যথার সঙ্গে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

  • জ্বর
  • বুকে ব্যথা
  • দ্রুত ওজন হ্রাস
  • ঘাড় থেকে ব্যথা শুরু হওয়া
  • হাঁচি, কাশি দিলে ব্যথা বেড়ে যাওয়া
  • কোমর থেকে নিচের অংশ দুর্বল হয়ে আসা
  • পিঠ বা কোমর ফুলে যাওয়া কিংবা বেঁকে যাওয়া
  • স্বাভাবিক প্রস্রাব-পায়খানার চাপ ধরে রাখতে না পারা
কোমরব্যথার বিপৎসংকেত

কখন যাবেন চিকিৎসকের কাছে

  • ধীরে ধীরে ব্যথার মাত্রা বাড়তে থাকলে
  • ব্যথার কারণে দৈনন্দিন কাজ বাঁধাগ্রস্ত হলে
  • ব্যথা শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো উন্নতি না হলে
  • ব্যথা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও মানিয়ে নিতে অসুবিধা হলে

চিকিৎসা ও প্রতিকার

সাধারণত পিঠ বা কোমরের ব্যথা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেরে যায়। অনেকে মনে করেন, কোমরব্যথায় সম্পূর্ণ বিশ্রাম বা বেড রেস্টে থাকতে হবে। এটি ঠিক নয়। বেশি বিশ্রামে ব্যথা বাড়তে পারে। দুই একদিন বিশ্রাম, প্রয়োজন অনুযায়ী গরম বা ঠান্ডা সেঁক ও হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব।

চিকিৎসা ও প্রতিকার

এ সময় ব্যথা কমাতে যা করতে পারেন—

  • ব্যথা শুরু হওয়ার পর দুই থেকে তিন দিন বিশ্রাম নিয়ে কাজে ফিরে যান। বেশি বিশ্রাম নিলে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
  • পেট, পিঠ ও কোমরের পেশির রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে পেশি শক্ত করতে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম বা সাঁতার কাটতে পারেন।
  • প্রথম দুই তিন দিন ঠান্ডা সেঁক দিয়ে এরপর গরম সেঁক দিলে সাময়িকভাবে আরাম পাবেন।
  • প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেনের মতো ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
  • ব্যথানাশক জেল বা ক্রিম ব্যবহার করে ব্যথার স্থানে হালকা মালিশ করতে পারেন।

কোমরব্যথা প্রতিরোধে যা করবেন

  • অতিরিক্ত শক্ত ও নরম বিছানা এড়িয়ে মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেয় এমন বিছানায় ঘুমান।
  • উপুড় হয়ে শোয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। বিছানা ছাড়ার সময় একপাশে কাত হয়ে উঠুন।
  • একটানা কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না। কাজের ফাঁকে বিরতি নিয়ে হাঁটাচলা করুন।
  • উঁচু হিলের জুতো এড়িয়ে এক ইঞ্চি পরিমাণের কম হিলের জুতো ব্যবহার করুন।
  • কোমর সোজা রেখে চেয়ারে বসুন।
  • ভারী জিনিস তোলা ও বহনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন।

কোমরব্যথা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সঠিক দেহভঙ্গিতে কাজ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। হাড়ক্ষয় এড়াতে ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা এবং বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।


অধ্যাপক ডা. আবু জাফর চৌধুরী বিরু

অধ্যাপক ডা. আবু জাফর চৌধুরী বিরু

ফেলো আর্থ্রোস্কপি অ্যান্ড রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি (ইউকে)
এমবিবিএস, এমএস (অর্থো) ফেলো আর্থ্রোস্কপি অ্যান্ড
স্পোর্টস মেডিসিন (ভারত)
চেয়ারম্যান ও বিভাগীয় প্রধান, অর্থ্রোপেডিক বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
চেম্বার: ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল।

LinkedIn
Share
WhatsApp