বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ও কার্যকরী একটি পদ্ধতি হচ্ছে রেডিওথেরাপি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে শরীরের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করা হয়। রেডিওথেরাপি, তেজস্ক্রিয়তা থেরাপি এবং ইরেডিয়েশন নামেও পরিচিত। ক্যানসার আক্রান্ত টিস্যু বা কোষ ধ্বংস করতে রেডিওথেরাপির মাধ্যমে উচ্চশক্তির বিকিরণ (যেমন এক্স-রে এবং গামা রশ্মি) ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ক্যানসারের ধরনের উপর নির্ভর করে যে রোগী শুধুমাত্র রেডিওথেরাপিতেই সুস্থ হবে নাকি তার কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি কিংবা সার্জারির প্রয়োজন আছে।
রেডিওথেরাপি কীভাবে কাজ করে
রেডিওথেরাপি পদ্ধতিতে বিকিরণের মাধ্যমে ক্যানসার বা টিউমারকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রেডিওথেরাপি হচ্ছে চুম্বকক্ষেত্রের মাধ্যমে সৃষ্ট একধরনের শক্তি, যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করে। শরীরের যে অংশে ক্যানসার হবে, শুধুমাত্র ঐ নির্দিষ্ট অংশে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। ক্যানসার আক্রান্ত ১০ জন ব্যক্তির মধ্যে ৪ জনকেই রেডিওথেরাপি দিতে হয়।
রেডিওথেরাপির ব্যবহার
- টিউমার ধ্বংসে।
- ব্যাথা উপশম করতে।
- অপারেশনের পূর্বে টিউমারকে সংকুচিত করে ছোট করে ফেলতে, যাতে অপারেশন করে অপসারণ করা সহজ হয়।
- অপারেশনের পরে অনেক সময় ক্ষতিকর কোষ থেকে যেতে পারে, সেগুলোকে নির্মূল করতে
- ক্যান্সার ছাড়াও আরো কিছু রোগের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়ে থাকে, যেমন- থাইরয়েডের সমস্যা, বিভিন্ন ধরনের রক্ত সম্পর্কিত রোগ, ইত্যাদি।
রেডিওথেরাপির ধরন
রেডিওথেরাপি সাধারণত দুই ধরনের। যথা- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ।
- বাহ্যিক রেডিওথেরাপি শরীরের বাইরে থেকে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এক্সরে, ইলেকট্রন ও কদাচিৎ প্রোটন ব্যবহার করা হয়। সাধারণত দিনে একবার করে কয়েক দিন বা সপ্তাহ ধরে কোর্স হিসেবে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়।
- অভ্যন্তরীণ রেডিওথেরাপি একধরনের তেজস্ক্রিয় উপাদান ব্যবহার করে, যা তরলে মেশানো থাকে এবং রোগী তা পান করে অথবা তন্ত্রের মধ্যে বা টিউমারের কাছাকাছি ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
রেডিওথেরাপি কতদিন দিতে হয়
ক্যানসার চিকিৎসার অংশ হিসেবে রেডিওথেরাপি কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিনে একবার করে সপ্তাহে পাঁচ দিন রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। ক্যানসার আক্রান্ত নয় এমন সুস্থ কোষগুলো যেন পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ পায় তাই মাঝে মাঝে বিরতি দেওয়া হয়।
ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির ভূমিকা
প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার অস্ত্রোপচার বা সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করা হলেও রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। তবে সব ধরনের ক্যানসারে প্রাথমিক অবস্থায় রেডিওথেরাপির প্রয়োজন পড়ে না। যেমন- কোলন ক্যানসার। এ ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সার্জারি বা কেমোথেরাপিই যথেষ্ট।
রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ক্যানসার কোষগুলো সুস্থ কোষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। রেডিওথেরাপির ফলে অনেকসময় এটি সুস্থ কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। রেডিওথেরাপির সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে-
- চামড়ায় কালশিটে পড়ে যাওয়া
- ক্লান্তিবোধ হওয়া
- অসুস্থবোধ করা
- মুখের ভিতর শুকিয়ে যাওয়া
- ক্ষুধামান্দ্য
- ডায়রিয়া
- চুল পড়া
- খাবার বা ঢোক গিলতে অস্বস্তিবোধ করা যৌনমিলনে অনাগ্রহ
- অস্থিসন্ধি ও পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া
ক্যান্সার যখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ওই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি চিকিৎসা হলো রেডিওথেরাপি। তাই যেখানে প্রাথমিক অবস্থায় রেডিওথেরাপির দরকার হয় না সেখানেও পরবর্তীতে রেডিওথেরাপি লাগতে পারে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা এতটা ফলপ্রসূ হয় না। যেমন- হেড-নেক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রধানতম চিকিৎসা হলো রেডিওথেরাপি। এ ছাড়া জরায়ু-মুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রেও রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়ে থাকে। ফুসফুসের ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, মস্তিষ্কের টিউমার এমন কোনও জায়গা নেই, যার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি ব্যবহার হয় না।
তাছাড়া রেডিওথেরাপির আরো কয়েক ধরনের দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যথা-
- সময়ের আগেই মেনোপেজ শুরু হওয়া।
- বন্ধ্যাত
- ত্বকের পরিবর্তন। যেমন- ত্বকের কোথাও কোথাও মোটা বা কালচে হয়ে যাওয়া কিংবা গভীর গর্তের মত সৃষ্টি হওয়া।
- শ্রোণীদেশের হাড়ের ছোটখাটো ভাঙ্গন যার ফলে নড়াচড়ার সময় তীব্র ব্যাথা।
- অনেক সময় মলত্যাগের বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা।
- অনেক সময় মলত্যাগের বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা।
- হাত বা পা ফুলে যাওয়া।
ডা. মোস্তফা আজিজ সুমন
এমবিবিএস, এমসিপিএস (রেডিওথেরাপি), এমডি (রেডিয়েশন অনকোলজি) সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, অনকোলজি বিভাগ
(কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল)
কনসালট্যান্ট, রেডিয়েশন অনকোলজি
ল্যাবএইড ক্যানসার হসপিটাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার