গনোরিয়ার উপসর্গ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
-ডা. মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান মাসুম
আফজাল হোসেন কিছুদিন যাবৎ বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়াসহ অণ্ডকোষে ব্যথা বোধ করছেন। ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হচ্ছে। ব্যাপারটাকে শুরুতে পাত্তা দেননি। কিন্তু সম্প্রতি খেয়াল করলেন, অণ্ডকোষ কিছুটা ফুলেও গেছে। এবার আর সচেতন না হয়ে পারলেন না। চিকিৎসকের কাছে গেলেন। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, আফজাল হোসেন গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।
গনোরিয়া কী, কীভাবে ছড়ায়
এটি একটি যৌন সংক্রামক রোগ। নিসেরিয়া গনোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। সংক্রমণের প্রধান কারণ অবাধ ও অনিরাপদ যৌনসম্পর্ক। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত ও সংক্রমিত তোয়ালে, জামা-কাপড় বা বিছানার চাদরের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে গনোরিয়া ছড়ায়। এমনকি সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনসম্পর্কের পর হাতে জৈবিক তরল লেগে থাকলে এবং সেই অবস্থায় চোখে হাত দিলেও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। তবে স্বাভাবিক স্পর্শ যেমন—চুম্বন, আলিঙ্গন, হাত ধরা, হাঁচি, কাশি—প্রভৃতির মাধ্যমে এটি ছড়ায় না। গর্ভবতী মা গনোরিয়ায় আক্রান্ত হলে গর্ভজাত সন্তানও সংক্রমিত হতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
নারী-পুরুষ উভয়ই এতে আক্রান্ত হতে পারেন। উভয়ের লক্ষণ ও উপসর্গের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে।
পুরুষ : অনেকের ক্ষেত্রে উপসর্গহীন থাকে। যাদের উপসর্গ প্রকাশ পায়, তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত ১—১৪ দিনের মাথায় এটি প্রকাশ পেতে থাকে। মোটাদাগে নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো দেখা যায়—
- প্রস্রাবের সময় ব্যথা ও জ্বালাপোড়া হয়।
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হয়।
- পুঁজের মতো সাদা অথবা হলুদ রঙের পদার্থ বের হয়।
- একটি অথবা দুটো অণ্ডকোষেই ব্যথা হয় এবং ফুলে যায়।
এছাড়া প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া বা প্রস্রাবের নালি ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হলে লিঙ্গ উত্থানে সমস্যা হতে পারে এবং উত্থিত হলে প্রচণ্ড ব্যথা বোধ হয়ে থাকে। এমনকি প্রস্রাবের রাস্তা সরু হয়ে প্রস্রাব বের হতে অসুবিধা হয়। ফলে ভেতরে থলিতে জমে যায়।
নারী : অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই এটি উপসর্গহীন অবস্থায় থাকে। মোটামুটি ৫০-৭৫ শতাংশ নারী কোনো ধরনের উপসর্গ লক্ষ করেন না। তবে উপসর্গ প্রকাশের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো দেখা যায়—
- প্রস্রাবের সময় খুব জ্বালাপোড়া ও ব্যথা হয়।
- পুঁজের মতো প্রস্রাব বের হয়।
- যৌনমিলনের সময় খুব ব্যথা হয় এবং রক্তপাত হয়।
- যৌনাঙ্গের আশপাশে ফুলে যেতে পারে এবং ফোঁড়া হতে পারে।
- কোমর ও তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
- রজঃচক্রের মাঝের সময়ে প্রচুর যোনিস্রাব ও রক্তপাত হয়।
গনোরিয়া শরীরের অন্যান্য অঙ্গকেও আক্রান্ত করতে পারে। যেমন—
মলদ্বার : চুলকানি, মলদ্বার দিয়ে পুঁজ বের হওয়া, মলত্যাগের সময় রক্ত বের হওয়া, মলত্যাগে কষ্ট হওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।
চোখ : এটি চোখেও প্রভাব ফেলে। চোখ ব্যথা, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা, চোখ দিয়ে পুঁজের মতো তরল বের হওয়া—এর লক্ষণ।
গলা : গনোরিয়ায় গলা সংক্রমিত হলে গলাব্যথার পাশাপাশি ঘাড়ের পাশের লিম্ফ নোড ফুলে যায়।
অস্থিসন্ধি : অস্থিসন্ধি সংক্রমিত হলে আক্রান্ত স্থান ফুলে যেতে পারে। লাল হয়ে যেতে পারে। নড়াচড়ার সময় প্রচণ্ড ব্যথা বোধ হতে পারে।
গনোরিয়ার জটিলতা
গনোরিয়ার সংক্রমণ ভয়ংকর জটিলতা তৈরি করতে পারে। নারীদের জননতন্ত্রের ডিম্ববাহী নালিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এতে আক্রান্ত নারী সন্তানধারণের ক্ষমতা হারাতে পারেন। আবার কোনো নারী গর্ভাবস্থায় আক্রান্ত হলে গর্ভের সন্তানও সংক্রমিত হতে পারে। গর্ভজাত সন্তান অপুষ্টির শিকার হতে পারে এবং চোখে সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি সন্তান অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে পুরুষের অণ্ডকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। শুক্রনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারাতে পারেন।
প্রতিরোধ
গনোরিয়া প্রতিরোধের প্রধানতম উপায় হচ্ছে নিরাপদ যৌনজীবন। এজন্য সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সঙ্গীর পূর্বে গনোরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো ইতিহাস আছে কি না—পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে তা নিশ্চিত হতে হবে। যেীনমিলনের সময় কনডম ব্যবহার করলেও নিরাপদ থাকা সম্ভব। কোনোভাবে সঙ্গী যদি গনোরিয়ায় আক্রান্ত হন তাহলে পুরোপুরি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত শারীরিক মিলন থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ডা. মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান মাসুম
এমবিবিএস, বিসিএস, ডিডিভি
চর্ম, অ্যালার্জি ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ
ও কসমেটিক ডার্মাটো সার্জন
সহকারী অধ্যাপক, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগ
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা
চেম্বার : ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিকস, খুলনা