গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও অন্যান্য

-ডা. মারুফা মোস্তারী

সাদিয়া সুলতানা। বয়স ৩৪। রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার বাসিন্দা। আগে কখনো ডায়াবেটিসের উপসর্গ লক্ষ করেননি। গর্ভধারণের আট মাস পর রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারেন তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সন্তান ধারণের এই পুরো সময়টা তাকে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলতে হয়েছে। হালকা শারীরিক ব্যায়াম করেছেন। পুষ্টিকর খাবার খেয়েছেন এবং নিয়মিত ইনসুলিন নিয়েছেন। জন্ম দিয়েছেন একটি সুস্থ সন্তান। তবে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে সবার ক্ষেত্রে সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তৈরি হয় নানান জটিলতা।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ধরন

নারীদের গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের ২০১৯-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের আট থেকে দশ শতাংশ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। সাধারণত গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নারীরা দুই ধরনের ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতার মধ্যে পড়েন।

  • যারা আগে থেকেই টাইপ-১ বা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
  • যারা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে বাচ্চারও পরবর্তী সময়ে স্থূলকায় হওয়ার এবং টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যেভাবে বুঝবেন

প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের গর্ভধারণের ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। রক্তে শর্করার মাত্রা দেখতে ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট করাতে হবে। শুরুতে স্বাভাবিক থাকলেও মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে বাচ্চারও পরবর্তী সময়ে স্থূলকায় হওয়ার এবং টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

নিচের উপসর্গগুলোর কোনোটি মিলে গেলে ২৪ সপ্তাহ পর আবার পরীক্ষা করাতে হবে।

  • ঝাপসা দৃষ্টি
  • অতিরিক্ত পিপাসা
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • বমিভাব বা বমি
  • অতিরিক্ত প্রস্রাব
  • ওজন হ্রাস
  • নাক ডাকা
  • ঘন ঘন ইনফেকশন
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও অন্যান্য

মা ও শিশুর ঝুঁকি

গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের জন্ম ও বেড়ে ওঠার জন্য প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল বিভিন্ন ধরনের হরমোন তৈরি করে। এ সময় গর্ভবতী মায়ের শরীরে বেড়ে যায় গ্লুকোজের মাত্রা। গ্লুকোজের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রয়োজন ইনসুলিন। অনেকের শরীর হঠাৎ এই পরিবর্তনে খাপ খাওয়াতে ও যথেষ্ট ইনসুলিন নিঃসরণ করতে পারে না। গর্ভাবস্থায় হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। দেখা দেয় ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিসের প্রবণতা থাকলে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। সাধারণত যাদের গর্ভসঞ্চারের প্রথম ১২ সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তারা আগে থেকেই আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু জানতেন না।

সাধারণত ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে ধরা পড়লে সেটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না হলে মা ও শিশু মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

এ সময় যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে-

  • মায়ের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া।
  • খিঁচুনি।
  • শিশুর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • অতিরিক্ত বমি।
  • রক্তস্বল্পতা ও রক্তক্ষরণ।
  • সময়ের আগেই প্রসব।
  • মৃত সন্তান জন্মদান।

এ ছাড়াও প্রসবের সময়ে নানান জটিলতা ও জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি থাকে ৮ শতাংশের বেশি।

ঝুঁকিতে আছেন যারা

  • যেসব গর্ভবতীর পরিবারে ডায়াবেটিস রোগী আছে।
  • যাদের পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের ইতিহাস আছে।
  • প্রথম গর্ভধারণের সময় প্রসূতির বয়স পঁচিশ বা তার বেশি হলে।
  • অতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটি।
  • উচ্চ রক্তচাপ।
  • আগে গর্ভধারণের সময়ে ডায়াবেটিস হয়ে থাকলে।
  • যাদের গর্ভপাতের ইতিহাস আছে।

চিকিৎসা

সাধারণত গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের ৫০ শতাংশের সন্তান প্রসবের পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস থাকে না। তবে, তাদের ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ। এ সময় মুখে খাওয়ার ওষুধ সেবন না করাই ভালো। যাদের গর্ভসঞ্চারের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে এবং মুখে ওষুধ খাচ্ছেন, তাদের গর্ভসঞ্চার হয়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই মুখে খাওয়ার ওষুধ বন্ধ করে ইনসুলিন নিতে হবে। অনেকের ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হয় না। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, নির্দিষ্ট সময় পরপর ডায়াবেটিসের মাত্রা নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত স্ত্রীরোগ বা ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া ও হালকা শরীরচর্চার মাধ্যমে এ সময় সুস্থ থাকা সম্ভব।


ডা. মারুফা মোস্তারী
এমবিবিএস, এফসিপিএস (এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবোলিজম), এমএসিই (ইউএসএ)
কনসালট্যান্ট এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, অন্যান্য হরমোন ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp