গ্যাস্ট্রিক আলসার : কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

অধ্যাপক ডা. বিমল চন্দ্র শীল

আলসার হতে পারে পাকস্থলীতে, ক্ষুদ্রান্তে কিংবা খাদ্যনালিতে। পাকস্থলিতে আলসার হলে তাকে বলা হয় গ্যাস্ট্রিক আলসার। আর ক্ষুদ্রান্ত বা ডিওডেনামে আলসার হলে তাকে ডিওডেনাল আলসার নামে ডাকা হয়। একত্রে এ সমস্ত আলসারকে পেপটিক আলসারও বলা হয়ে থাকে। পাকস্থলীতে আলসার হলে পেটে জ্বালাপোড়াসহ নানা লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু অনেকেই শুরুতে এসব লক্ষণ সাধারণ গ্যাস্ট্রাইটিস ভেবে এড়িয়ে যান। এটি ঠিক নয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করলে, দীর্ঘ মেয়াদে এটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।

গ্যাস্ট্রিক আলসার কী

আলসার অর্থ ঘা বা ক্ষত। গ্যাস্ট্রিক আলসার হলো পাকস্থলীর ক্ষত। পাকস্থলীতে অ্যাসিডের দ্বারা এই ক্ষত বা প্রদাহের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রতিনিয়ত পাকস্থলীতে অ্যাসিড উৎপন্ন হয়ে থাকে। এগুলো খাবার হজমে সহায়তা করে। আর আমাদের পাকস্থলীর ভেতরের দেয়ালে মিউকাস মেমব্রেন নামক একটি স্তর বা প্রলেপ থাকে, যা পাকস্থলীর আস্তরণকে অ্যাসিডের সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু, কোনো কারণে অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে এই স্তরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে, অ্যাসিড সরাসরি পাকস্থলীর আস্তরণের সংস্পর্শে এসে ক্ষত সৃষ্টি করে। এভাবে আলসার তৈরি হয়।

গ্যাস্ট্রিক আলসারের কারণ

নানা কারণে গ্যাস্ট্রিক আলসার হতে পারে। তবে, গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রধান কারণ হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ভাইরাসের সংক্রমণ। এই ভাইরাস দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। পাকস্থলীতে প্রবেশ করার পর, এই ভাইরাস মিউকাস মেমব্রেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যার ফলে, পাকস্থলীতে ক্ষত বা প্রদাহের সৃষ্টি হয়।

গ্যাস্ট্রিক আলসার : কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

আবার, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রক্সেন, এসিক্লোফেনাক বা অ্যাসপিরিনের মতো নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস বা এনএসএআইডিএস-জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে বা উচ্চ ডোজে সেবন করলে আলসার হতে পারে। এ ছাড়া, নিদ্রাহীনতা, ধূমপান ও মদ্যপান, জন্মগতভাবে পরিপাকতন্ত্রের গঠনগত কাঠামো দুর্বল হওয়া, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ আলসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। অতিরিক্ত মসলা ও তেল-চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খেলেও ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ ও উপসর্গ

  • পেটে জ্বালাপোড়া, অসহনীয় ব্যথা ও পেট ফুলে থাকা।
  • বুকে ব্যথা ও জ্বালা করা।
  • বমি ভাব বা বমি।
  • কখনো বমির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে।
  • অতিরিক্ত ঢেকুর ওঠা এবং খাবার গিলতে সমস্যা।
  • মলের সঙ্গে রক্তপাত এবং মলের রং খয়েরি অথবা কালো হওয়া।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ও ক্ষুধামান্দ্য।
  • বদহজম ও দ্রুত ওজন হ্রাস।

রোগনির্ণয়

আলসার নির্ণয় করতে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে অ্যান্ডোস্কোপি পরীক্ষা। এ পদ্ধতিতে একটি নলের সাহায্যে পাকস্থলীতে ক্যামেরা প্রবেশ করানো হয় এবং সরাসরি আক্রান্ত স্থানের ছবি তোলা হয়। এর মাধ্যমে কোথায়, কোন অংশে, কতটুকু জায়গাজুড়ে আলসার হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়। এছাড়াও, এ রোগ নির্ণয়ে ইউরিয়া শ্বাস পরীক্ষা, রক্তের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা (অ্যান্টি-এইচ পাইলোরি আই জি) ও স্টুল অ্যান্টিজেন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়।

গ্যাস্ট্রিক আলসার : কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

চিকিৎসা

আলসারের চিকিৎসায় প্রথমে রোগের কারণ জানা জরুরি। যদি পাকস্থলীতে হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থাকে, তবে সাধারণ গ্যাসের ওষুধে রোগ নিরাময় হবে না। এ ক্ষেত্রে এইচ পাইলোরিনাশক অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হবে। যদি এইচ পাইলোরির সংক্রমণ না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অ্যাসিড নিঃসরণ রোধকারী ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।

আলসার প্রতিরোধে করণীয়

গ্যাস্ট্রিক আলসারে আক্রান্ত হলে, ওষুধ সেবনের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে, এ রোগ দ্রুত উপশম হয়। তবে যেহেতু, রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধই শ্রেয়, তাই আক্রান্ত হওয়ার আগে রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকলে অনেকাংশে এর ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এজন্য প্রাত্যহিক জীবনে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলা উচিত। যেমন—

গ্যাস্ট্রিক আলসার : কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
  • এইচ পাইলোরি যাতে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
  • টং দোকানের খোলা পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন।
  • বাসায় ফিল্টার মেশিনে পানি ফিল্টার করে বা আগুনের তাপে ভালো করে ফুটিয়ে পানি পান করুন।
  • ফল-ফলাদি খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে নিন। যাতে ক্ষতিকর জীবাণু দূর হয়ে যায়।
  • রাস্তার পাশের খোলা খাবার, জাঙ্কফুড, অতিরিক্ত মসলাদার ও তৈলাক্ত খাবার পরিহার করুন।
  • মদ ও ধূমপান বর্জন করুন। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত নিজের পছন্দে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাবেন না।
  • যেকোনো ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।

অধ্যাপক ডা. বিমল চন্দ্র শীল

অধ্যাপক ডা. বিমল চন্দ্র শীল
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), এফআরসিপি (ইংল্যান্ড)
এমডি (গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি), মেম্বার- আইএসজি (ইন্ডিয়া)
ফেলো, থেরাপিউটিক এন্ডোস্কপি (এআইআইএমএস, দিল্লি, এআইজি, হায়দরাবাদ)
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ (প্রাক্তন)
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা
মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp