ঘামাচি : প্রতিকার ও প্রতিরোধ
-ডা. এ. কে. এম. রেজাউল হক
আমাদের শরীরে ঘাম তৈরি হলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা ঘর্মগ্রন্থির মাধ্যমে বের হয়ে ত্বকের উপরিভাগে চলে আসে। প্রচণ্ড গরমে অতিরিক্ত ঘাম তৈরি হলে তখন সেই ঘাম ঘর্মগ্রন্থির ছিদ্রপথ দিয়ে বের হতে পারে না। ফলে ত্বকের নিচের ঘর্মগ্রন্থি ফেটে যায়। এই পরিস্থিতিতে ত্বকে ছোটো ছোটো র্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়, যা ঘামাচি নামে পরিচিত। ঘামাচি অত্যন্ত পরিচিত একটি চর্মরোগ। ঘর্মগ্রন্থির সমস্যা থেকে এর উৎপত্তি বলেই এই নামকরণ। ঘামাচিকে ইংরেজিতে বলা হয় প্রিকলি হিট র্যাশ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় মিলিয়ারিয়া।
শিশুদের ক্ষেত্রে মাথায়, ঘাড়ে, বগলে, শরীরের ওপরের অংশে, রানের ভাঁজে, কনুই ও হাঁটুর ভাঁজে ঘামাচি হতে দেখা যায়। আবার বড়োদের বুকে-পিঠে-পেটে ঘামাচি হয়। সাধারণত শিশুরা অতিরিক্ত গরমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না বলে তাদের ঘর্মগ্রন্থির মুখ আটকে যায়। ফলে শিশুদের মধ্যে বেশি ঘামাচি হতে দেখা যায়। ঘামাচি হলে ত্বকে জ্বালাপোড়া, চুলকানিসহ নানা ধরনের অস্বস্তি হতে পারে।
ঘামাচির কারণ ও ধরন
ব্যক্তিভেদে নানা কারণে ঘামাচি বা মিলিয়ারিয়া দেখা দেয়। তীব্র গরমে অবস্থান করলে, দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগলে বা কোনো কারণে শয্যাশায়ী থাকলে ঘামাচি হতে পারে। আবার অসুস্থতার কারণে অতিরিক্ত ঘাম হলে বা ত্বকে ময়লা জমে থাকলে ঘামাচি হতে পারে। ঘামাচির কারণ এর ধরনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ঘামাচির ধরন মূলত ৩ টি।
- মিলিয়ারিয়া ক্রিস্টালিনা (Miliaria Cristalina)
- মিলিয়ারিয়া প্রফান্ডা (Miliaria Profunda)
- মিলিয়ারিয়া রুব্রা (Miliaria Rubra)
মিলিয়ারিয়া ক্রিস্টালিনা সাধারণত শিশুদের বেশি হতে দেখা যায়। এমনকি শিশুর জন্মের দ্বিতীয় সপ্তাহেই এটি দেখা দিতে পারে। ত্বকের এপিডারমিস থেকে এই ঘামাচি হয়ে থাকে। এই ধরনের ঘামাচি হলে ত্বকে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ ছোটো ছোটো দানা হয়। কিছুদিনের মধ্যে আপনা-আপনিই এটি সেরে যায়। মিলিয়ারিয়া প্রফান্ডাও ক্রিস্টালিনার মতোই। ছোটো ছোটো দানা আকারে ত্বকে দেখা দেয়। একসময় নিজে নিজেই সেরে যায়। সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দেয় মিলিয়ারিয়া রুব্রা। ত্বকে অতিরিক্ত ময়লা জমে ঘর্মগ্রন্থি বন্ধ হয়ে গেলে এবং ঘর্মনালি আবদ্ধ হয়ে গেলে এই ধরনের ঘামাচি হয়। এই ঘামাচিতে ত্বকে লাল ফুসকুড়ি দেখা দেয়। ফুসকুড়ির সঙ্গে থাকে ত্বকে চুলকানি, জ্বালাপোড়ার মতো উপসর্গ। কখনো কখনো ঘামাচির মধ্যে পুঁজ জমতে দেখা যায়। এই ঘামাচি ছোটো-বড়ো যেকোনো বয়সী মানুষেরই হতে পারে।
ঘামাচির প্রতিকার ও প্রতিরোধ
প্রচলিত আছে, বর্ষার প্রথম বর্ষণ নাকি ত্বকের রোগবালাই দূর করে এবং বৃষ্টির পানিতে ঘামাচির যন্ত্রণার উপশম হয়। প্রচলিত এই ধারণা পুরোপুরি সত্য কি না তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি মেলেনি এখনো। তবে বৃষ্টির পানির তাপমাত্রা কম থাকার কারণে এই পানিতে ভিজলে ঘামাচির যন্ত্রণার খানিকটা লাঘব হয়। মূলত অতিরিক্ত ঘামের কারণে ঘর্মগ্রন্থির নিঃসরণে বাধা বা ঘর্মগ্রন্থির প্রদাহ ঘামাচির কারণ। সেক্ষেত্রে শীতল পানির পরশ ঘামাচির সাময়িক এবং আংশিক প্রতিকার দেয়।
এছাড়া শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঠান্ডা ঘরে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করলে ঘামাচি থেকে পরিত্রাণ মেলে। নিয়মিত গোসল করলে এবং আক্রান্ত স্থানে ঠান্ডা পানি ও বরফ লাগালে যন্ত্রণা কমে। এক্ষেত্রে ক্যালামাইন লোশনও বেশ কাজে দেয়। ঘামাচি হলে অতিরিক্ত গরম পরিবেশ ও শারীরিক পরিশ্রম থেকে বিরত থাকা জরুরি। ঘামাচি মারাত্মক রূপ নিলে স্টেরয়েড ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ক্রিম ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
এছাড়া ঘামাচি প্রতিরোধে মেনে চলুন কিছু নিয়ম-কানুন :
- সরাসরি রোদের উত্তাপ এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে ছাতা ব্যবহার করুন।
- গরম স্থানে বেশিক্ষণ অবস্থান করবেন না। ঠান্ডা ও শীতল পরিবেশে অবস্থান করুন।
- পোশাকের ক্ষেত্রে বেছে নিন সুতির পাতলা ও ঢিলেঢালা পোশাক।
- নাইলনের পোশাক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- আবদ্ধ স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে না থেকে বাতাস চলাচল করে এমন ঘরে ঘুমান।
- ত্বকে বারবার ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিন।
- ত্বকে পানি দিলেও ত্বক ভেজা রাখবেন না। পানি দেওয়ার পরপরই ত্বক মুছে ফেলুন।
- অতিরিক্ত গরমে পানিশূন্যতা যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- বাইরে থেকে ঘরে এসে সঙ্গে সঙ্গেই গোসল করবেন না।
- শিশুদের রাবার ও প্লাস্টিকের সিটের ওপর শোয়ানো থেকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
- ঘুমন্ত শিশুকে কিছুক্ষণ পরপর পাশ পরিবর্তন করে দিন।
- ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করতে পারেন। তবে ব্যবহারের আগে ত্বক ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন।
- ত্বকে কোনো তেল ব্যবহার করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শমতো লোশন বা অয়েনমেন্ট ব্যবহার করুন।
ঘামাচি প্রতিকারে ক্ষেত্রবিশেষে অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে সব অ্যান্টিহিস্টামিন সবার জন্য নিরাপদ নয়। তাই সাধারণ এই বিষয়গুলো মেনে চলার পরও ঘামাচিতে ভুগলে বা ঘামাচি থেকে পুঁজ বের হলে দ্রুত একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ডা. এ. কে. এম. রেজাউল হক
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) চর্ম ও যৌন
মেম্বার অব ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব সেক্সুয়াল মেডিসিন
চর্ম, যৌন, কুষ্ঠ, অ্যালার্জি, সেক্স ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, চর্ম ও যৌন (সেক্স), কুষ্ঠ ও অ্যালার্জি বিভাগ
বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতাল), শাহবাগ, ঢাকা
চেম্বার : ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক্স, মিরপুর-১