বার্ধক্যের আঘাত ধারাবাহিকভাবে যে অঙ্গগুলোকে আহত করে তার মধ্যে একেবারে শুরুর দিকেই শিকার হয় চোখ। চোখ ঘোলাটে হয়ে আসে। কাছের জিনিসটিও ঝাঁপসা লাগে। খবরের কাগজ পড়া, মুঠোফোন ব্যবহার করা কিংবা টেলিভিশনের প্রিয় অনুষ্ঠানটি দেখতে বড়ো অসুবিধা হয়। মানবদেহের অন্যতম প্রধান অঙ্গ এই চোখ। বিষ্ময়ভরা পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখার আমৃত্যু সাধ মানুষের। চোখের ছানি সেই সাধে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়েছে বিস্ময়করভাবে। চোখের ছানির মতো অস্বস্তিকর রোগটি বর্তমানে চিকিৎসাশাস্ত্রে খুবই সহজ একটি বিষয়।
চোখে ছানি কী? কীভাবে হয়?
সহজ কথায়, চোখে ছানি হচ্ছে চোখের লেন্স ঘোলাটে বা সাদা ধরনের হয়ে যাওয়া। রোগটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ক্যাটার্যাক্ট’। এটি কীভাবে হয় তা বুঝতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে আমরা কীভাবে দেখি। অর্থাৎ চোখ দিয়ে আমাদের দর্শনের যে অনুভ‚তি হয়, সেই দর্শনের প্রক্রিয়াটি কীভাবে সংঘটিত হয়।
আমাদের চোখ অনেকগুলো আবরণযুক্ত গোল বলের মতো। এর সামনের দিকে রয়েছে কর্নিয়া এবং লেন্স। যা বাইরের আলোকরশ্মিকে চোখে প্রতিফলিত করে। এই প্রতিফলিত প্রতিবিম্বটি গিয়ে পড়ে চোখের পেছনের রেটিনাতে। এরপর সেই প্রতিবিম্ব রেটিনা থেকে চলে যায় মস্তিস্কে। তখন মস্তিষ্কে দর্শনের অনুভ‚তি তৈরি হয় এবং আমরা দেখতে পাই। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি ক্যামেরার কর্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
এই কর্নিয়া এবং লেন্স; দর্শনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার জন্য একেবারে প্রাথমিক ভ‚মিকা পালন করে এরা। এ দুটোকে হতে হয় স্বচ্ছ এবং মাধ্যমটাও পুরোপুরি স্বচ্ছ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোথাও কোনোরকম অস্বচ্ছতা থাকলে প্রতিবিম্ব যথাযথভাবে পড়বে না। চোখের এই লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে যাওয়াকেই মূলত চোখে ছানি পড়া বলে।
উপসর্গ
দৃষ্টি ঘোলাটে হওয়া বা চোখে কম দেখা ছাড়া চোখে ছানি পড়ার উপসর্গগুলো তেমন সুনির্দিষ্ট নয়। চোখে ব্যথা হওয়া কিংবা চোখ থেকে পানি নির্গত হওয়ার মতো দৃশ্যমান উপসর্গ এতে নেই। তবে নিম্নোক্ত লক্ষণসমূহ অনুভব করলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
- চোখে ঝাপসা দেখা।
- একটি জিনিস দুটো দেখা।
- অন্ধকারে কম দেখা।
- রঙের অনুভ‚তি কমে যাওয়া।
- চোখে আলো পড়লে অস্বস্তিবোধ হওয়া।
- চশমা পরার পরও দৃষ্টি ঠিক না হওয়া।
- আলোতে গেলে দৃষ্টিশক্তি কমে আসা।
কারণ

- প্রধান কারণ বার্ধক্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত লেন্সের উপাদান তথা প্রোটিনের গঠন নষ্ট হয়ে যেতে থাকে।
- গর্ভাবস্থায় মা যদি হামে (রুবেলা) আক্রান্ত হন, অপুষ্টি বা ডায়াবেটিসে ভোগেন কিংবা টোক্সোপ্লাজমা জাতীয় ভাইরাস আক্রমণের শিকার হন তাহলে শিশুর চোখে ছানি পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- শিশুর গঠনপ্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকলেও জন্মগত ছানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- চোখে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সংক্রমণ থাকলে সেই সংক্রমণ ছানিতে রূপ নিতে পারে।
- দীর্ঘ সময় রোদে কাজ করলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবেও এ রোগ হতে পারে।
- দীর্ঘদিন ধরে স্টেরোয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করলে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
- চোখে আঘাত পেলে ছানি পড়তে পারে।
- দীর্ঘদিন ধরে মায়োপিয়াজনিত (ক্ষীণদৃষ্টি) সমস্যায় ভুগলে চোখে ছানি পড়ে যেতে পারে।
- এ ছাড়া চর্মরোগ, অ্যালার্জি, হাঁপানি, মেটাবলিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণেই চোখে ছানি পড়ে।
চিকিৎসা
চোখে ছানির চিকিৎসা স্বল্পব্যয়ের এবং খুব সহজ। তবে যথাসময়ে চিকিৎসা না নিলে চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই চোখে কোনো অসংলগ্নতা দেখা দিলেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। প্রাথমিকভাবে চশমা ব্যবহারে সমাধান না হলে, অপারেশন লাগতে পারে। লেন্স প্রতিস্থাপন বা অপারেশন ছাড়া এর তেমন কোনো চিকিৎসা নেই।
নিন্মোক্ত কয়েকটি পদ্ধতিতে চোখের ছানি অপারেশন করা হয়।

- ইসিসিই: চোখের স্বচ্ছ কর্নিয়া ও সাদা অংশের মাঝ বরাবর কেটে ছানি বের করে এনে কৃত্রিম লেন্স সংযোজন করা। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রের আধুনিকায়নের ফলে এই অপারেশন এখন তেমন হয় না।
- এসআইসিএস: সাধারণত যেখানে ফ্যাকো সার্জারির সুবিধা নেই, সেখানে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এর খরচ তুলনামূলক কম। একে বলা হয় ম্যানুয়াল ফ্যাকো।
- ফ্যাকো সার্জারি: চোখের ছানি অপারেশনে এটি আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি। এটি অত্যন্ত সুবিধাজনক পদ্ধতি। সার্জারির পরপরই রোগী বাড়ি চলে যেতে পারেন। দ্রæত আরোগ্য লাভের পাশাপাশি অপারেশন পরবর্তী জটিলতা হওয়ার আশঙ্কাও কম। সর্বাধুনিক এই পদ্ধতিতে মাত্র ২.৫ মি.মি ছিদ্র করে অপারেশন করা হয়।
——————————————————————————————————————————————————

ডা. আনসারুল হক
এমবিবিএস, ডিও, এফআরএফএ
ফেলো ভিট্রিও-রেটিনাল সার্জারি (ভারত)
চিফ কনসালট্যান্ট
ভিট্রিও-রেটিনাল ও লেজার সার্ভিস
ল্যাবএইড আই সেন্টার, ঢাকা