জটিল চর্মরোগ সোরিয়াসিস
-ডা. মাহমুদ চৌধুরী
পেশায় রন্ধনশিল্পী হৃদির বয়স ৩৫ বছর। সম্প্রতি তিনি খেয়াল করেন, তার হাতের ত্বক অত্যন্ত খসখসে হয়ে গেছে। রান্না ও অন্যান্য কাজে বারবার হাত ধোয়ার কারণে এমন হয়ে থাকতে পারে ভেবে শুরুতে তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তার হাত আরো খসখসে হয়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে মাছের আঁশের মতো সাদা খসখসে হয়ে যায় ত্বক। হৃদির মনে পড়ে, তার বাবার হাঁটুতেও এমন হয়েছিল। তাই বেশ ঘাবড়ে যান তিনি। দ্রুত একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন।

হৃদির হাতের ত্বকের অবস্থা দেখে চিকিৎসক জানান, তিনি সোরিয়াসিস (Psoriasis) নামক একধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। যেহেতু তার বাবার এই রোগ ছিল তাই বংশগতভাবেই তিনি রোগটি পেয়েছেন। সোরিয়াসিসে পারিবারিক ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি পুরোপুরি নিরাময় হয় না, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
কেন হয় সোরিয়াসিস?
সোরিয়াসিস এক বিশেষ ধরনের চর্মরোগ। এটি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে নয়। সাধারণত শরীরের বিভিন্ন স্থানের ত্বকে, বিশেষ করে হাঁটু, কনুই, পিঠ, হাত ও পায়ের তালু এবং মাথার ত্বকে লালচে ছোপ পড়ে। এরপর ত্বকে রুপালি বা সাদা খসখসে মাছের আঁশের মতো পরিবর্তন দেখা দেয়। এই অবস্থাকে বলা হয় সিলভার স্কেল। মাথার ত্বকে সোরিয়াসিস হলে অনেকসময় তা খুশকি মনে হতে পারে। সোরিয়াসিস একধরনের অটোইমিউন রোগ। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলে এই রোগ হতে পারে। এছাড়া আরো যেসব কারণে হতে পারে—
- বংশে কারো সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকলে।
- কোনো দুর্ঘটনায় ত্বক ছিলে গেলে, পুড়লে বা ব্যথা পেলে।
- অতিরিক্ত রোদে অবস্থান করলে ত্বক পুড়ে সোরিয়াসিস হতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপ, ম্যালেরিয়ার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এটি বাড়তে পারে।
- স্থূলতার কারণে সোরিয়াসিস বাড়তে পারে।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাকলে বাড়তে পারে।
- ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে বাড়তে পারে।
- শরীরে ট্যাটু বা উল্কি আঁকার কারণে সোরিয়াসিস বাড়তে পারে। কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে বাড়তে পারে।
সোরিয়াসিসের উপসর্গ
- ত্বকের আক্রান্ত অংশে পুরু লালচে দাগ পড়ে।
- আক্রান্ত অংশে ব্যাথা বা চুলকানি হতে পারে।
- যকৃতের নানা রোগ ও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- ত্বকের আক্রান্ত অংশের রং নষ্ট হয়ে যায়। কনুই, হাঁটু, মাথা, হাত ও পায়ের নখে এটি বেশি হয়।
- আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ ও রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।
- আক্রান্ত স্থান রুপালি-সাদা আঁশ দ্বারা আবৃত থাকে এবং লালচে বর্ণের ক্ষত দেখা যায়।
চিকিৎসা এবং সোরিয়াসিসের সঙ্গে জীবনযাপন
সোরিয়াসিস পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। তবে এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য অসুখ। এই রোগ নিরাময়ে আক্রান্ত স্থানের ওপর বিভিন্ন ধরনের মলম ও ক্রিম লাগাতে হয়। আলট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়েও এর চিকিৎসা করা হয়। এই রোগ কখনোই পুরোপুরি সারে না। আবার এতে রোগীর মৃত্যুও হয় না। তবে দীর্ঘমেয়াদে জটিলতা বাড়তে থাকে। জীবনব্যাপী এই রোগ মোকাবিলা করতে হয়। কখনো কখনো সোরিয়াসিসে ত্বকের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় অস্থিসন্ধির সমস্যাও।
নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিলে সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। নিয়ন্ত্রণে রেখেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। তবে এক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি—

- বারবার গোসল করা এবং গোসলের সময় অতিরিক্ত সাবান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- গোসল করা বা ত্বক ভেজানোর পর দ্রুত ভালোভাবে ত্বক মুছে ময়েশ্চারাইজার বা লোশন ব্যবহার করতে হবে।
- ত্বক শুকনো রাখা যাবে না। কিছুক্ষণ পরপর ত্বকে তৈলাক্ত জিনিস, যেমন—নারকেল তেল, অলিভ অয়েল বা ভ্যাসলিন ঘন ঘন ব্যবহার করতে পারেন।
- ত্বকের পরিবর্তন দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া যাবে না। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নিতে হবে।
- আক্রান্ত স্থানে চুলকানি বা যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

ডা. মাহমুদ চৌধুরী
এমবিবিএস, ডিডিভি, এমসিপিএস, এফসিপিএস
চর্ম, যৌন, কুষ্ঠ, সেক্স ও অ্যালার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগ
চেম্বার: ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিকস) এনেক্স
ধানমন্ডি, ঢাকা