জন্ডিস নিয়ে যতো বিভ্রান্তি!

জন্ডিস নিয়ে যতো বিভ্রান্তি!

বর্ষাকালে স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর বৃষ্টি হয়। এ সময় নদ-নদী, খাল-বিল পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও বন্যা শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। ফলে চারদিকে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ, যেমন—ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, ম্যালেরিয়া প্রভৃতির প্রকোপ বেড়ে যায়। এ সময় আরেকটি রোগ দেখা দেয়, তা হলো—জন্ডিস। জ্বরের মতো জন্ডিসও নিজে কোনো রোগ নয়। এটি মূলত কোনো রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়।

জন্ডিস কী? কেন হয়?

মানুষের রক্তের অনেক উপাদানের মধ্যে একটি বিলিরুবিন। এই বিলিরুবিনের উৎপত্তি রক্তের লোহিত কণিকা থেকে। রক্তের লোহিত কণিকা যখন স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকভাবে ভেঙে যায় তখনই লিভারে বিলিরুবিন তৈরি হয় এবং প্রধানত পিত্তরসের মাধ্যমে ও কিছু অংশ পরবর্তী সময়ে রক্তে প্রবাহিত হয়ে প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়। বিলিরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে এটি জমা হতে থাকে শরীরের বিভিন্ন কোষ-কলায়। তখন কোষ-কলার স্বাভাবিক রং পরিবর্তিত হয়ে হলুদাভ হয়ে যায়। ত্বক ও চোখের ঝিল্লি হলুদ রং ধারণ করলে তা দৃশ্যমান হয় এবং জন্ডিস হয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়।

জন্ডিস নিয়ে যতো বিভ্রান্তি!

জন্ডিস মূলত তিনটি কারণে দেখা দেয়—

  • হেপাটাইটিস বা যকৃতের প্রদাহ।
  • পিত্তনালির ব্লক বা পিত্তরসের পথে বাঁধা।
  • হিমোলাইসিস বা সময়ের আগেই লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়া।

জন্ডিস যে ধরনের বা যে কারণেই হোক না কেন এটি সব সময়ই একটি গুরুতর উপসর্গ। ভাইরাস সংক্রমণ থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের মতো রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে এই জন্ডিস। জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

জন্ডিসের উপসর্গ

  • জ্বর
  • শারীরিক দুর্বলতা
  • পেটে ব্যথা
  • ক্ষুধামান্দ্য
  • বমিভাব বা বমি
  • চুলকানি
  • দ্রুত ওজন কমে যাওয়া
  • চোখ ও ত্বকের রঙ হলুদ হয়ে যাওয়া
  • প্রস্রাবের রঙ হলুদ হওয়া
  • মলের রঙ পরিবর্তন

জন্ডিসে আক্রান্ত হলে যা করবেন

ভাইরাস হেপাটাইটিসজনিত কারণে জন্ডিস সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই সেরে যায়। কারণ এ সময়ে শরীরে বিলিরুবিনের পরিমাণ ব্যালেন্স হয়ে যায়। তবে বারবার জন্ডিস হওয়া মারাত্মক কোনো রোগকে ইঙ্গিত করে। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে যেসব বিষয় মেনে চলতে হবে—

জন্ডিস নিয়ে যতো বিভ্রান্তি!
  • সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করুন।
  • বিশুদ্ধ পানি পান করুন এবং তরল খাবার খান।
  • ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম নিশ্চিত করুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকুন।
  • সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার তৈরি করুন ও খান।
  • শরীরে রক্ত নিতে হলে স্ক্রিনিং করিয়ে নিন।
  • ডিসপোজাল সিরিঞ্জ ছাড়া শরীরে কোনো ইনজেকশন নেবেন না।
  • হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করুন।
  • অন্যের ব্যবহৃত ব্লেড, রেজর ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

জন্ডিস নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা

অনেকে মনে করেন জন্ডিস হলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ কমাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পানি, আখের রস, ডাবের পানি, গ্লুকোজের শরবত ইত্যাদি পান করতে হবে। জন্ডিসের রোগীকে হলুদ দিয়ে রান্না করা তরকারি খেতে দেওয়া যাবে না, এতে জন্ডিস বেড়ে যাবে। জন্ডিসে আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ শিশুকে পান করালে শিশুও আক্রান্ত হবে।

ওপরে উল্লিখিত প্রচলিত এসব বিশ্বাসের আসলে কোনো ভিত্তি নেই। জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর স্বাভাবিকের চেয়ে কম পানি পান করলে সমস্যা হতে পারে, তবে অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন নেই। রোগীকে স্বাভাবিক পরিমাণেই পানি খেতে হবে। অতিরিক্ত পানি পানে বিলিরুবিনের মাত্রা কমে না, বরং ঘন ঘন প্রস্রাব করার জন্য রোগীকে বারবার টয়লেটে যেতে হতে পারে। এতে রোগীর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটে।

আবার, খাবারে হলুদ ব্যবহারের সঙ্গে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই রোগীর খাবারে হলুদ দেওয়া যাবে না এটি সত্য নয়। অন্যদিকে আখের রসকে আমাদের দেশে জন্ডিসের অন্যতম পথ্য মনে করা হয়। আখের রস জন্ডিসের রোগীদের বর্জন করাই শ্রেয়। রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া আখের রসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে হেপাটাইটিস-এ বা ই ভাইরাস।

অনেকেই এ সময় জন্ডিসে আক্রান্ত মায়ের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে নিষেধ করেন। যা পুরোপুরি ঠিক নয়। মায়ের দুধের মাধ্যমে জন্ডিস শিশুর মধ্যে সংক্রমিত হয় না। তবে, আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের যদি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসজনিত জন্ডিস হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই হেপাটাইটিস- বি ভাইরাসের টিকা ও ইমিউনোগ্লোবুলিন ইনজেকশন দিয়ে নিতে হবে।

সুতরাং, জন্ডিস হলে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি জন্ডিসের কারণ নির্ণয়ের জন্য আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।


অধ্যাপক ফারুক আহমেদ

অধ্যাপক ফারুক আহমেদ

এমবিবিএস (ডিএমসি), এমডি (হেপাটোলজি), এফআরসিপি (লন্ডন)
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, লিভার বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp