টেনিস এলবো উপশমে করণীয়
কলেজপড়ুয়া রাফি প্রতিদিন বিকেলে বাসার পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলে। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং সে-ই করে। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ কনুই থেকে হাতের কবজি পর্যন্ত ব্যথা শুরু হয়েছে তার। ব্যাট ধরলে বা ভারী কিছু তুলতে গেলেই তীব্র ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে জানতে পারে টেনিস এলবো রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে।
যেসব কাজে কনুই ও কবজি বেশি ব্যবহৃত হয় সেসব ক্ষেত্রে টেনিস এলবোতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। গৃহিণী থেকে প্রোগ্রামার, পেশাদার বাবুর্চি থেকে ক্রিকেটার যে কেউ টেনিস এলবোতে আক্রান্ত হতে পারেন। ২০০৪ সালে বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার আক্রান্ত হয়েছিলেন টেনিস এলবো রোগে। এই অসুখের কারণে অনেকদিন পর্যন্ত হাতে ব্যাট তুলতে পারেননি তিনি।
টেনিস এলবো কী?
টেনিস এলবো মূলত কোমল পেশির বাত যা কনুই সন্ধির ওপরের মাংসপেশিকে আক্রান্ত করে। হাতের কনুই থেকে শুরু করে আঙুল পর্যন্ত ব্যথায় শিরশির করে ওঠে। দৈনন্দিন কাজ করতে এমনকি হাত নাড়াচাড়া করতেও ব্যথা হয়।

তবে হাতের পেছনের দিকেও ব্যথা ছড়াতে পারে। টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথম এই রোগটি দেখা যায় বলেই এটি টেনিস এলবো (Tennis Elbow) নামে পরিচিত। রিউম্যাটোলজির পরিভাষায় একে বলা হয় ল্যাটারাল অ্যাপিকনডাইলিটিস।
যেসব কারণে টেনিস এলবো হয়
সাধারণত কনুইয়ের বাইরের দিকের উঁচু অংশটিকে ল্যাটারাল অ্যাপিকনডাইল বলা হয়। এই অ্যাপিকনডাইল থেকে কিছু মাংসপেশি তৈরি হয় যেগুলোকে বলা হয় এক্সটেনসর অরিজিন মাংসপেশি। এই পেশিগুলো টেন্ডন দ্বারা হতের সঙ্গে যুক্ত থাকে, কবজি প্রসারিত করতে সাহায্য করে। টেনিস এলবো তখনই হয় যখন বাহুতে এক্সটেনসর কার্পি রেডিয়ালিস ব্রেভিস নামের একটি নির্দিষ্ট পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণত পুনরাবৃত্তিমূলক চাপ এই পেশিকে দুর্বল করে ফেলে। যেখানে এটি কনুইয়ের বাইরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, সেখানে পেশির টেন্ডনে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ছিদ্র সৃষ্টি হয়। এই ছিদ্র প্রদাহ ঘটায়, ফলে ব্যথা অনুভূত হয়। বাহু সোজা করতে বা সম্পূর্ণভাবে প্রসারিত করতে গেলে ব্যথা বোধ হয়।
যাদের ঝুঁকি বেশি
সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তি যারা ডায়াবেটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিসসহ বিভিন্ন বিপাকজনিত রোগে ভুগছেন তাদের এই রোগে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এছাড়া টেনিস, ক্রিকেট বা গলফ খেলার সময় যারা বেকায়দায় i¨vকেট বা ব্যাট ধরেন তাদের পেশিতে ক্রমাগত চাপ পড়ে। চাপের কারণে ধীরে ধীরে পেশিমূল ও অস্থির আবরণের মাঝে ক্ষত তৈরি হয়। পরবর্তীকালে এই ক্ষত থেকে প্রদাহ হতে পারে। সাঁতার কাটা, কম্পিউটার চালনা, ক্রমাগত চাবি ঘুরানো, ঘন ঘন স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহার করলেও টেনিস এলবো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। টেনিস এলবোতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে যাদের—

- ক্রিকেট, টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়
- হাতুড়ি ও স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহারকারী
- কাঠমিস্ত্রি, পেইন্টার বা রং মিস্ত্রি ও পেশাদার বাবুর্চি
- টাইপিস্ট, স্টেনোগ্রাফার
- মোটরসাইকেল চালক
- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী
- রান্না ও সাংসারিক কাজে ব্যস্ত নারী
- বিভিন্ন ধরনের আর্থ্রাইটিস যেমন- রিউম্যাটয়েড, গাউটে আক্রান্ত ব্যক্তি
টেনিস এলবো’র উপসর্গ
টেনিস এলবো রোগের মূল লক্ষণ কনুই থেকে হাতের কবজি পর্যন্ত ব্যথা। কনুই ভাঁজ বা সোজা করার সময় তীব্র ব্যথা হতে পারে। অনেকসময় কবজি ডান থেকে বাম পাশে নাড়াচাড়া করতেও ব্যথা হয়। পরিস্থিতি জটিল হলে হাতের সামান্য নাড়াচাড়াতেও তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়াও যেসব উপসর্গ দেখে টেনিস এলবো বোঝা যেতে পারে—
- হাত নাড়াচড়া করতে ও কাজ করতে অসুবিধা
- হাত ভাঁজ করতে বা মুষ্টিবদ্ধ করতে না পারা
- ভারী জিনিস তুলতে হাতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়া
- ভেজা কাপড় নিংড়ানো, চামচ দিয়ে কিছু
- নাড়ানো বা করমর্দনে অসুবিধা
- দরজা খুলতে বা বন্ধ করতে অসুবিধা
- কনুই থেকে শুরু হয়ে হাতের আঙুল পর্যন্ত ব্যথা
- কনুই ফুলে যাওয়া
- ব্যথার স্থানে চামড়ার রং পরিবর্তন
চিকিৎসা ও পরামর্শ
ঘরোয়া কাজ, মোটরসাইকেল চালানো, ভারী জিনিস উত্তোলন বা কম্পিউটারের মাউস ধরে একটানা কাজ করলে কনুই ব্যথা হতে পারে। হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত ব্যথা হলে, স্বাভাবিক কাজ করতে অসুবিধা হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। অনেকসময় শুধু উপসর্গ বুঝে রোগের কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। কারণ জানতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতে হয়। টেনিস এলবো রোগের কারণ শনাক্ত করতে এক্স-রে, এমআরআইসহ অন্যান্য পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত এর চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এই রোগের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি বেশ উপকারী। আল্ট্রাসাউন্ড, আইস ম্যাসাজ ও প্রয়োজনীয় এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম এই অসুখ সারাতে সাহায্য করে।
যদি বারবার একই কাজ করার সময় ব্যথা বাড়ে তাহলে সেই কাজ থেকে বিরত থাকুন। এ সময় কনুই পুরোপুরি বিশ্রামে রাখতে হবে। নাড়াচাড়া এড়াতে এলবো ব্যাগ ব্যবহার করা ভালো।

অতিরিক্ত বিশ্রামে কনুই শক্ত হয়ে জমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যথা কমে এলে পেশি সচল রাখতে হাত নাড়াচাড়া ও ব্যায়াম করা যেতে পারে। রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যথার স্থানে ঠান্ডা বা গরম তাপ প্রয়োগ করলে রোগী কিছুটা আরাম পেতে পারেন। জটিলতা বাড়লে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ওষুধ বা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় উপশম না হলে সিআরপি থেরাপি দিতে হবে। এটি অত্যন্ত আধুনিক একটি চিকিৎসাব্যবস্থা এবং রক্তের মাধ্যমে এটি কার্যকর করা হয়।

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ
এমবিবিএস, এফসিপিএস (ফিজিক্যাল মেডিসিন), পিএইচডি, এমএসিপি (আমেরিকা)
ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিউম্যাটোলজি
বাতব্যথা ও জয়েন্ট রোগ বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক, ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
চেম্বার : ল্যাবএইড লিঃ (ডায়াগনস্টিকস)