ডেঙ্গু ও কোভিড: উপসর্গগত মিল ও প্রতিকারে করণীয়

ডা. জুবায়ের আহমদ

কামাল হোসেনের বয়স ৩৩। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। হঠাৎ জ্বর আসায় ভেবেই নেন তার করোনা হয়েছে। যেহেতু জ্বর ছাড়া আর কোনো জটিলতা ছিল না তাই চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়েই আইসোলেশনে থাকতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন কামাল হোসেন। শরীরে তীব্র ব্যথার পাশাপাশি শুরু হয় অভ্যন্তরীণ রক্তপাত। রক্তচাপ কমে যাওয়াসহ আরো বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা দেয় তার, যা করোনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানান, তার আসলে করোনা হয়নি, হয়েছে হেমোরেজিক ডেঙ্গু।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে ডেঙ্গু জ্বর। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার যেহেতু এখন ঊর্ধ্বমুখী তাই কারো জ্বর হলেই ধরে নেয় যে করোনা হয়েছে। আবার একইসঙ্গে ডেঙ্গু ও করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে প্রতিদিন। চলতি বছরের শুরু থেকে মাসিক হিসেব দেখলেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশ বোঝা যায়।

ডেঙ্গু নাকি কোভিড-১৯
কোভিডের এ সময়টাতে জ্বর হলে দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরাই স্বাভাবিক। তার ওপর কোভিড কোভিডের এ সময়টাতে জ্বর হলে দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরাই স্বাভাবিক। তার ওপর কোভিড এবং ডেঙ্গু, দুটি রোগের লক্ষণে মিল থাকায় সমস্যাটি জটিল হচ্ছে। জ্বর ছাড়াও এ দুটি রোগেই মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা, বমি হওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। তাই এখন জ্বর হলে ডেঙ্গু ও করোনা দুটি বিষয়ই মাথায় রাখতে হবে। করোনা ও ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণে যেমন মিল আছে তেমনি কিছু পার্থক্যও আছে। যেমন- কোভিড হলে স্বাদ ও গন্ধ টের পেতে অসুবিধা হয়, ফুসফুস আμান্ত হয়। অবস্থা গুরুতর হলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। অপরদিকে ডেঙ্গুর অন্যতম প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, শরীরে ও চোখের পেছন দিকে ব্যথা। এছাড়া হেমোরেজিক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে পায়খানা কালো হওয়া, চোখের কোনা, মাড়ি ও নাক বা কান দিয়ে রক্ত বের হওয়া, মহিলাদের পিরিয়ড শুরু হওয়া এবং অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এসময় যত দ্রæত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।

‘‘কোভিড-১৯ এর সময়টাতে জ্বর হলে দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরাই স্বাভাবিক।
তার ওপর কোভিড এবং ডেঙ্গু, দুটি রোগের লক্ষণে মিল থাকায় সমস্যাটি জটিল হচ্ছে।’’

চিকিৎসাপদ্ধতি
লক্ষণে মিল থাকলেও কোভিড ও ডেঙ্গুর চিকিৎসাপদ্ধতিতে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাছাড়া হাসপাতালগুলোতে কোভিড আক্রান্ত রোগী বেশি থাকায় অন্যান্য রোগীদের জন্য শয্যা খালি থাকছে না। তাই এ সময়ে জ্বর হলে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে।
প্রাথমিক অবস্থায় ডেঙ্গুজ্বরের আলাদা কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও নিয়ম মেনে চললেই পাঁচ থেকে দশ দিনের মধ্যে রোগী নিজে নিজেই সুস্থ হয়ে যায়। তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে অনেকসময় রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। এমনকি প্লাটিলেটও দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
অপরদিকে, যদিও কোভিডরোগী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে যায়, কিন্তু যদি রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয় কিংবা অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যেতে থাকে সেক্ষেত্রে রোগীকে আলাদা করে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এমতাবস্থায় হাসপাতালে নিতে হবে।

একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও করোনায় আক্রান্ত হলে
ডেঙ্গু ও কোভিড, দুটি রোগের আলাদা আলাদা জটিলতা থাকলেও এ দুটি যদি একসঙ্গে কাউকে আক্রান্ত করে সেক্ষেত্রে ভয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কোভিডের কারণে রোগীর ফুসফুস আক্রান্ত হলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এমনিতেই কমে যায়। আবার ডেঙ্গু বা কোভিড দুটোই রক্তে ভাস্কুলাইটিস সমস্যার সৃষ্টি করে। এতে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। যদি একই সঙ্গে ডেঙ্গুর কারণে রক্তে প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি কমে যায় এবং কোভিডের কারণে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ এর নিচে নেমে যায় তাহলে বিষয়টি বিপজ্জনক।
সাধারণত কেউ একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও কোভিড আক্রান্ত হয়ে থাকলে তাকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে অধিক মাত্রায় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণে বেশকিছু ঝুঁকি আছে।

করণীয়
এ অবস্থায় ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা এবং কোভিডের জন্য অক্সিজেন স্যাচুরেশন, দুটি বিষয়ের দিকেই খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গুর ভাইরাস মনোসাইট নামে রক্তের একটি সেলে বৃদ্ধি লাভ করে। অন্যদিকে করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে বৃদ্ধি লাভ করে। ডেঙ্গু কখনো ফুসফুস আক্রান্ত করে না। করোনা ফুসফুসের এপিথিলিয়াল সেলে প্রদাহ তৈরি করে। শরীরের নানা অংশে এই সেলের উপস্থিতি রয়েছে। তাই সেখানেও করোনাভাইরাস প্রদাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম। দুটি ভাইরাস দুইভাবে বৃদ্ধিলাভ করায়, এ দুটি মিলে নতুন ধরনের জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা কম। তবে একসঙ্গে দুটি রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার মতো রোগ প্রতিরোধক্ষমতা রোগীর আছে কিনা সেটিই কথা। তাই এসময় রোগীকে বাড়িতে রাখার চেয়ে হাসপাতালে রাখাই শ্রেয়।
ডেঙ্গু ও কোভিড-১৯ দুটি রোগের ক্ষেত্রেই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সহজ। ডেঙ্গ প্রতিরোধে বাড়ির ভেতর ও আশপাশ পরিষ্কার রাখুন, মশারি টাঙিয়ে ঘুমান, মশার বৃদ্ধি রোধ করুন। কোভিড প্রতিরোধে বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি
মেনে চলা আর যতটা সম্ভব বাড়িতে থাকার চেষ্টা করুন। নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকে নিরাপদ রাখুন।


ডা. জুবায়ের আহমদ
এমবিবিএস, এমডি (ইন্টারনাল মেডিসিন)
ক্লিনিকাল ফেলো-রিউম্যাটোলজি ও ইমিউনোলজি, সিঙ্গাপুর
ক্লিনিক্যাল ফেলো- পেডিয়াট্রিক ও এডোলেসেন্ট রিউম্যাটোলজি (অস্ট্রেলিয়া ও মুম্বাই)
শিশু ও মহিলা বাত ও লুপাস বিশেষজ্ঞ
মেডিসিন, এলার্জি ও রিউম্যাটোলজি বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp