ডেঙ্গু জ্বরে আতঙ্ক নয়: যা করবেন
ডেঙ্গু জ্বর, যার আরেক নাম ব্রেকবোন ফিভার—অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি রোগ। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় এর প্রকোপ বেড়ে যায়। রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায় রোগটি। প্রতি বছর প্রচুর মানুষ এতে আক্রান্ত হন এবং মারাও যান অনেক রোগী। রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয় বলে শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা প্রবলভাবে ভেঙে পড়ে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে সতর্কতা জরুরি। ডেঙ্গু জ্বরে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না।
যেভাবে ছড়ায় ডেঙ্গু
মশার কামড়: স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। ডেঙ্গু-আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে স্ত্রী এডিস মশা কামড়ানোর পর ডেঙ্গুর ভাইরাস মশাটির অন্ত্রে প্রবেশ করে। এরপর এই ভাইরাস মশার লালাগ্রন্থিসহ অন্যান্য সেকেন্ডারি টিস্যুতে পরিবাহিত হয়। একবার আক্রান্ত হওয়ার পর ওই মশাটি মৃত্যু পর্যন্ত এ ভাইরাস বহন করে এবং অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।
গর্ভবতী মা থেকে শিশু: গর্ভবতী মা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে গর্ভস্থিত সন্তানও এতে আক্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে শিশুটি অপরিপক্ক, অল্প ওজনসম্পন্ন বা অন্য কোনো বড়ো রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে।
অন্যান্য: রক্তদান বা অঙ্গদানের মাধ্যমেও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা অঙ্গ অন্য কেউ গ্রহণ করলে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন।
ডেঙ্গুর ধরন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিম্নোক্তভাবে ডেঙ্গুর ধরনের কথা উল্লেখ করেছে—

হালকা
অন্যান্য লক্ষণ ও জটিলতা ছাড়া কেবল জ্বর।
মাঝারি
সতর্কতামূলক লক্ষণ : পেটে ব্যথা, বিরামহীন বমি, দাঁতের মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত, যকৃতের আকৃতি বেড়ে যাওয়া, হেমাটোক্রিট বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দ্রুত হারে রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া।
অধিক ঝুঁকিতে যারা : শিশু, গর্ভবতী মা, বয়স্ক ব্যক্তি, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এমন ব্যক্তি, হার্ট-কিডনি-
লিভারে সমস্যা আছে যাদের।
তীব্র
লক্ষণ : ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া প্রভৃতি), এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম (শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে জটিলতা ছড়িয়ে যাওয়া)।
ডেঙ্গুর ধাপ
মশার কামড়: এটি ভাইরাসের উন্মেষপর্ব। সময়কাল—পাঁচ থেকে সাত দিন।
জ্বর: সময়কাল ০-৭ দিন। এ সময় শরীরে ভাইরাসের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে।
সংকটকাল: এই সময়টি সবচেয়ে ভয়ের। এ সময় শরীরে ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকে না ঠিকই, তবে রোগী সবচেয়ে সংকটপূর্ণ অবস্থা পার করেন এই সময়েই। মাত্র ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী হয় পর্যায়টি। এ পর্যায়ে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে।
নিরাময়: সময়কাল ৩-৫ দিন। এ পর্যায়ে রোগীর দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি থাকে না। রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ডেঙ্গুর ঝুঁকিপূর্ণ উপসর্গ
ডেঙ্গুর প্রধান উপসর্গ হচ্ছে উচ্চমাত্রার জ্বর। জ্বরের মাত্রা ৯৯° ফারেনহাইট থেকে ১০৪° ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। এডিস মশার কামড়ের তিন থেকে ১৪ দিনের মাথায় লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। জ্বর, মাথাব্যথার মতো সাধারণ লক্ষণগুলোর বাইরে নিম্নোক্ত লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।

- তীব্র পেটে ব্যথা
- অনবরত বমি
- বমি, মল, দাঁতের মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত
- ক্লান্তি ও অস্থিরতা
- যকৃতের আকার বৃদ্ধি (দুই সে.মি.-এর বেশি)
- রক্তের হেমাটোক্রিট বেড়ে যাওয়া এবং দ্রুত হারে প্লাটিলেট কমে যাওয়া
- ৪-৬ ঘণ্টা খুবই অল্প পরিমাণে বা একেবারেই প্রস্রাব না হওয়া
ডেঙ্গু রোগীকে কখন হাসপাতালে নেবেন
ডেঙ্গু রোগীকে কখন হাসপাতালে নিতে হবে বা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে—এ নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে থাকেন। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আক্রান্ত রোগীর মধ্যে লক্ষ করলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
- ওপরে বর্ণিত ডেঙ্গুর ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণসমূহ দেখা দিলে
- দেহের তাপমাত্রা দ্রুত হারে ওঠানামা করলে
- প্রচণ্ড ক্লান্তি, খাবারে অরুচি বা তীব্র পানিশূন্যতা দেখা দিলে
- অতিমাত্রায় রক্তপাত হতে থাকলে
- রক্তের শ্বেতকণিকা ৫,০০০-এর নিচে এবং রক্তের প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নেমে গেলে
- পালস প্রেশার (নাড়ির চাপ) ২০ এমএমএইচজি-র কম হলে
ডেঙ্গুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা
যথাসময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হলে আক্রান্ত রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এজন্য লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডেঙ্গু হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। ডেঙ্গু নির্ণয়ে সাধারণত নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলো করা হয়—
- সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট)
- ডেঙ্গু এজি এনএস১
- ডেঙ্গু আইজিজি অ্যান্ড আইজিএম

ডা. এ.বি.এম. সফিউল্লাহ কবির
এমবিবিএস, এফআরসিপি (ইউকে)
ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল
রাত হলে জ্বর আসে
জ্বর আসা স্বাভাবিক। তবে রাতে জ্বর আসা মোটেও স্বাভাবিক নয়। রাতে জ্বর আসার কারণে সারাদিন ক্লান্তি, ঝিমুনি, হতাশা, ক্ষুধামান্দ্য প্রভৃতি দেখা দেয়। অনেকসময় ত্বকের সংক্রমণ ও অ্যালার্জিজনিত কারণেও রাতে জ্বর হয়। আবার বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে অ্যান্ডোকার্ডাইটিস, যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে রাতে জ্বর হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। কখনো কখনো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং ক্লান্তি থেকেও রাতে জ্বর আসতে পারে। তাই নিজেকে সবসময় শান্ত ও দুশ্চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। শারীরিক সামর্থ্যের বাইরে কোনো কাজ করবেন না। এমনভাবে কাজ করুন যেন কাজটা নিজের কাছে চাপ মনে না হয়।