থ্যালাসেমিয়া: নিয়মিত চিকিৎসা প্রয়োজন

অধ্যাপক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম

সালটি ১৯৩২। নিউইয়র্কের চিকিৎসক থমাস কুলি স্থানীয় ছেলেমেয়েদের শরীরে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেন। যেমন- শরীরের তুলনায় পেট অস্বাভাবিক মোটা, হাত-পা অত্যধিক সরু, চোখের রঙ হলুদ, দৈহিক গড়নের তুলনায় মাথার আকৃতি অতিরিক্ত বড়ো ইত্যাদি। গবেষণা করে দেখেন, এদের প্রত্যেকেই বিশেষ একধরনের রক্তরোগে আক্রান্ত। তিনি ল্যাটিন সমুদ্র থ্যালাসের নামানুসারে রোগটির নামকরণ করেন ‘থ্যালাসেমিয়া’। তবে ডাক্তার কুলির নামের সঙ্গে মিলিয়ে একে অনেকেই কুলি’স অ্যানিমিয়াও বলে থাকেন।

থ্যালাসেমিয়া কী


এটি একধরনের জটিল রক্তরোগ। এ রোগে রক্তে হিমোগ্লোবিনের তৈরির জন্য দায়িত্বশীল জিন দুটো অস্বাভাবিক থাকে। বংশ পরম্পরায় শিশুর দেহে বাসা বাঁধে। থ্যালাসেমিয়ার রোগের ফলে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমতে থাকে। আক্রান্ত রোগীর রক্তে লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যায়। ফলে রক্তাল্পতার সমস্যা দেখা দেয়। যদি বাবা-মা দুজনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, সেক্ষেত্রে সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া ধরন


থ্যালাসেমিয়া সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে।
আলফা থ্যালাসেমিয়া: এর চেন তৈরি হয় চারটি জিন দিয়ে। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটির মধ্যে এক বা একাধিক জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। জিন যত ত্রæটিপূর্ণ হবে, সমস্যা তত বাড়বে। একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তাঁর সন্তানের মধ্যে এ রোগ ছড়াতে পারে। দু’টি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেট। তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। একে বলা হয় হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ। চারটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে বলা হয় আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর বা হাইড্রপস ফিটালিস।

বিটা থ্যালাসেমিয়া: এর চেন গঠিত হয় দুটি জিন দিয়ে। মা-বাবার কাছ থেকে প্রাপ্ত জিন ত্রুটিপূর্ণ হলেই বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে। একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে কিছুটা কম উপসর্গ দেখা যায়। একে বলা হয় বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেট। দু’টি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। একে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর অথবা হাইড্রপস ফিটালিস। নবজাতক যে শিশুদের এই সমস্যা থাকে, তারা সাধারণত জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকে। তবে জন্মের প্রথম দু’বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ


থ্যালাসেমিয়ার প্রধানতম লক্ষণটি হচ্ছে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা। অন্য লক্ষণগুলো হচ্ছে-

  • ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া।
  • দেহে অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া।
  • প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া।
  • মুখের হাড়ের বিকৃতি বা মঙ্গলয়েড ফেসিস।
  • শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া।
  • পেটের বাইরের দিক প্রসারিত হয়ে যাওয়া।
  • গাঢ় রঙের মূত্র।
  • হৃৎপিন্ডের সমস্যা।

থ্যালাসেমিয়া যেভাবে শনাক্ত করা হয়

প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ বিচার করে ধারণা করা গেলেও তিনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। যেমন-

  • হাই পাওয়ার লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি বা এইচপিএলসি পরীক্ষা।
  • কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি।
  • ডিএনএ টেস্ট।
  • হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস টেস্ট।
  • এছাড়া হাত ও মাথার এক্সরে করা হয়।

  • থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। কিন্তু এ রোগ কোনোভাবেই ছোঁয়াচে নয়।
  • থ্যালাসেমিয়া মানেই মৃত্যু নয়। বরং নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
  • বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা নিশ্চিত হতে রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো ।
  • পরিবারে একজনও যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তবে বাকিদেরও পরীক্ষা করা আবশ্যক।

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা

অ্যানিমিয়া মাইনর থ্যালাসেমিয়ায় সাধারণত কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মেজর থ্যালাসেমিয়া হলে নিয়মিত চিকিৎসার প্রয়োজন। যেমন-

ব্লাড ট্রান্সফিউশান: এক্ষেত্রে রোগীকে নিয়মিত রক্ত বদলাতে হয়।

মেডিকেশন ও সাপ্লিমেন্ট-আয়রন সিলেকশন: দেহের অতিরিক্ত আয়রন বের করে দেওয়ার জন্য আয়রন চিলেটিং দেওয়া হয়ে থাকে। আয়রনযুক্ত খাবার এবং ওষুধ খাওয়া যাবে না। এর সঙ্গে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে।

প্লীহা ও গল ব্লাডার বাদ দেওয়া: বারবার রক্ত দেওয়ার ফলে অনেকের প্লীহা বড় হয়ে যায়। তখন সেটি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফেলে দিতে হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গল বøাডারও বাদ দেওয়া হয়।

বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট: থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকর চিকিৎসা হচ্ছে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন।


অধ্যাপক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম
এমবিবিএস, এমসিপিএস (মেডিসিন),
এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (ক্লিনিক্যাল হেমাটোলজি)
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
হেমাটোলজি, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল সিনিয়র কনসালট্যান্ট,
ল্যাবএইড ক্যানসার হসপিটাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার

LinkedIn
Share
WhatsApp