নবজাতকের যত্ন

-অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান

হাসিব ও রুমানা দম্পতির প্রথম সন্তান এসেছে পৃথিবীতে। মেয়ের প্রসবের খবরে ছুটে এসেছেন রুমানার মা আমেনা বেগম। বাসায় ঢুকে হাতমুখ না ধুয়েই বাচ্চাকে কোলে তুলে শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে নেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই বাচ্চাকে গোসল করাতে বসে যান। রুমানা শালদুধ খাওয়াতে চাইলেও তিনি কৌটার দুধ গুলে খাইয়ে দেন। জন্মের কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই নেতিয়ে পড়ে শিশু। শরীর ঠাণ্ডা হতে শুরু করে।

একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, জন্মের সেই দিন থেকে পরবর্তী ২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী শিশুকে বলা হয় নবজাতক। মা ও শিশুর জন্য এই সময়টা অত্যন্ত নাজুক। শিশুকে সুস্থ রাখতে সঠিক যত্ন, ভালোবাসা ও পরিচর্যার বিকল্প নেই। তবে, অসচেতনতা ও অসাবধানতাবশত অনেকেই মারাত্মক কিছু ভুল করে ফেলে। গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে অসচেতনতার কারণে মারা যায় অনেক নবজাতক। মা ও নবজাতকের সুস্থতা নিশ্চিত করতে প্রসব পরিকল্পনা, পরিচর্যা ও যত্ন গুরুত্বপূর্ণ।

নবজাতকের সুরক্ষায় প্রথম ধাপ

নবজাতকের নিউমোনিয়া ও ঠাণ্ডার সমস্যা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। জন্মের প্রথম সপ্তাহে শিশুকে রাখতে হবে বাড়তি সতর্কতায়, মেনে চলতে হবে কিছু নিয়মকানুন।

  • জন্মের পরপরই শুকনো নরম কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিন।
  • নবজাতককে মায়ের বুকের সাথে ত্বকে ত্বক স্পর্শ করে রাখুন।
  • নবজাতককে আবহাওয়া অনুযায়ী উষ্ণ রাখুন।
  • জন্মের পর ৭২ ঘণ্টার আগে নবজাতককে গোসল করাবেন না।
  • নাড়ি বাঁধা ও কাটার পরপরই নাভিতে ক্লোরোহেক্সিডিন দ্রবণ লাগান।
  • জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শালদুধ খাওয়ানো শুরু করুন।
  • জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশুর ওজন নিন।

নবজাতকের বিপদচিহ্ন

  • জ্বর
  • খিঁচুনি
  • নাভিপাকা
  • নেতিয়ে পড়া
  • শরীর ঠান্ডা হয়ে আসা
  • মায়ের দুধ খেতে না পারা
  • দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস

জন্মের পরপরই নবজাতককে মায়ের
বুকের সাথে ত্বকে ত্বক স্পর্শ করে রাখুন।

শিশুর পরিচর্যায় ভুল ধারণা

নবজাতক জন্মের পরপরই অনেকে মাথার চুল ফেলে দেন। এটি ঠিক নয়। চুল শিশুর টুপির কাজ করে, শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে, সর্দি-কাশিতে কম আক্রান্ত হয়। নবজাতক সুস্থ থাকে। শিশুর বয়স এক মাস পূর্ণ হওয়ার আগে চুল না ফেলে দেওয়াই ভালো। নবজাতককে শালদুধ খাওয়াতে চান না কেউ কেউ। তবে, শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে শালদুধ জরুরি।

শিশু জন্মের পরপরই মায়ের শালদুধ খাওয়ান। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধই শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট। ওজন কম হলে শিশুর বয়স সাত দিনের আগে কখনোই গোসল করানো যাবে না। এতে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কমে হাইপোথারমিয়া হতে পারে। ওজন ঠিক থাকলে ৩ দিন পর গোসল করানো যাবে। শিশুর নাভি শুকাতে তেল বা লোশন ব্যবহারের কোনোও প্রয়োজন নেই। দশ দিন পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শিশুর নাভি শুকিয়ে পড়ে যায়। অন্য কিছু ব্যবহার করলে নাভি পেকে যেতে পারে।

প্রথম মাসের নাজুক সময়ে চাই বাড়তি যত্ন

  • নবজাতকের সংস্পর্শে আসার আগে ভালোভাবে ধুয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করে নিন।
  • শিশুদের নখ দ্রুত বাড়ে। তার নিজের নখের মাধ্যমে ত্বকে আঁচড় লাগতে পারে। সব সময় শিশুর নখ ছোটো রাখুন।
  • শিশুর নাভি যত শুষ্ক হবে তত দ্রুত পড়ে যাবে। নাভি সব সময় শুষ্ক রাখুন।
  • অনেক সময় দুধ খাওয়াতে গিয়ে নবজাতকের চোখে দুধ চলে যেতে পারে। হতে পারে প্রদাহ। নরম সুতি কাপড় দিয়ে শিশুর চোখ মুছে দিন।
  • দুধ খাওয়ার কারণে শিশুর জিহ্বায় সাদা আস্তর পড়ে যেতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে জিহ্বা পরিষ্কার করে দিন।
  • শিশুকে ডায়াপার পরানোর আগে ত্বকে হালকা করে বেবি অয়েল মেখে নিন। এতে ডায়াপারের ঘষায় ত্বকে র‍্যাশ পড়বে না র‍্যাশ পড়লে আর অয়েল ব্যবহার করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অয়েনমেন্ট ব্যবহার করুন। ডায়াপার লাইন খেয়াল রাখুন এবং সময়মতো পাল্টে দিন।

নবজাতক জন্মের পর সবসময় সতর্ক থাকুন। নবজাতক যদি মায়ের দুধ টেনে না খেতে পারে কিংবা শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, দ্রুত হাসপাতালে নিন।


অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান
এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি (পেডিয়াট্রিক), এমডি (নিওন্যাটোলজি)
ফেলো নিওন্যাটোলজি, এনইউএইচ (সিঙ্গাপুর)
এক্স-চেয়ারম্যান, নিওন্যাটোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ঢাকা
শিশু ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।

LinkedIn
Share
WhatsApp