ক্ষণিকায় কবিগুরু এভাবেই দেখেছেন বয়স্ক হওয়াকে। এ হলো জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি। একে বরণ করে নেওয়ার মধ্যে গৌরব আছে। একে ইতিবাচকভাবে দেখা নিজের আর সমাজের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে ।
সংসারে বয়স্ক লোক বা মুরুব্বিরা বটবৃক্ষের মতো। কী শোভা আর কী মায়া এই বৃক্ষে। গ্রাম বাংলার আদিমতম এই বৃক্ষকে সংসারের সবচেয়ে বয়স্ক লোকের সাথে তুলনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘শতেক শাখা বাহু তুলি, বায়ুর সাথে কোলাকুলি, আনন্দেতে দোলাদুলি, গভীর প্রেম ভরে।’ আমাদের সংসারে বৃদ্ধ মা বাবা তেমনই বটবৃক্ষ। আজ যৌথপরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সেই আশ্রয় সেই নিরাপদ ভরসার স্থল অনেকেই হারিয়েছেন।
আমি যখন কাজ করি বিলেতে তখন অনেক প্রতিষ্ঠানে আর হাসপাতালে দেখেছি অতি প্রবীণ ব্যক্তি আছেন বিভাগে, সব কাজকর্ম চলছে ঠিকঠাক কিন্তু কোনো শাসন নেই। সেই বটবৃক্ষের উপস্থিতি সবাইকে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে কাজ করতে স্বতঃ প্রণোদিত করে।
আজকাল আমাদের সংসারে এমন বয়স্ক মানুষ বা মুরুব্বি পাওয়া যাবে মাত্র গুটিকয়েক সংসারে। তাদের অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার স্পর্শ থেকে অনেকেই নিজেরা নিজেদের বঞ্চিত করি। সমাজে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার জন্য পরিবারে বয়স্ক লোকের সম্মান আর তাঁর আদর্শে, পরামর্শে পথ চলা আজ যেন খুব জরুরি মনে হয়।
বৃদ্ধ মানে এক টুকরো ছাদ। মাথার উপর বিশাল আকাশ। বয়স্ক বাবা বা মা যতটা না গুরুজন তারচেয়ে বেশি হয়ে উঠতে পারেন বন্ধু। অনেক সময় তাদের সান্নিধ্য দেয় নিশ্চিন্তিপুরের সন্ধান।
দেশে দেশে আন্তর্জাতিক বার্ধক্য দিবস পালিত হয়। আমার একটি অনুরোধ, নিজের বয়স্ক বাবা-মা দাদা-দাদি আর অন্য বয়স্কদের সম্মান করুন। তাদের সময় দিন। তাদের চাহিদা বুঝুন। কথা বলুন তাদের সঙ্গে। আমাদের সমাজের ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়। বয়স্করা যেন মনে না করেন, বার্ধক্য উপভোগের বিষয় নয়। যেন বয়স হওয়াকে তারা মনে না করেন, অনেক দুঃখ বেদনা ঝড় ঝঞ্ঝা পেরোনোর কাল।
দেখেছি, অনেক বয়স্ক লোক একা থাকেন। দিন কেটে যায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নামে। দুটি চোখ এক করতে পারেন না। কি যেন চিন্তায় চোখের পাপড়ি সিক্ত, অবসন্ন হয়ে থাকে।
আমি অনেক দেশে দেখেছি, সিনিয়র সিটিজেনদের আলাদা সম্মান আলাদা মর্যাদা আর অগ্রাধিকার। কিন্তু দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলি, আমাদের সমাজে সেই নীতি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
বয়স্ক মানুষদের ভালো রাখার দায়িত্ব সবার। আর সে জন্য প্রয়োজন তাদের সহযোগিতা করা। গত বছর অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বার্ধক্য দিবসের থিম ছিল, বিশ্বের সব বয়স্ক মানুষদের ভালো থাকতে সাহায্য করা।
কোভিড অতিমারিতে ইউরোপ আমেরিকাসহ নানা দেশে বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যুহার বাড়লেও প্রবীণদের সংখ্যা খুব কমেছে তা নয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালে প্রতি ১১ জনের মধ্যে ১ জন থাকবে ৬৫ উত্তীর্ণ ।
উত্তর পুরুষেরা জীবিকার প্রয়োজনে অন্যত্রই বাস করে। আর হয়তো বাড়ির বয়স্ক মানুষ পলকা শরীর আর ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে থাকেন অর্থকষ্টে।
বয়স্ক হলে সবচেয়ে বড় সমস্যা নিঃসঙ্গতা। কোভিড সময়ে একাকীত্ব আরও বেশি গ্রাস করেছে তাঁদের। সে সঙ্গে থাকে বার্ধক্যের অসুখ। তাই তাদের মাস্ক পরা, ঘরের বাইরে না যেতে দেওয়া আর উপসর্গ হলে চিকিৎসক দেখানো। আর এসব কিছুর জন্য চাই ঘরের অন্যদের নজরদারি। ক্রনিক অসুখ থাকলে চাই চেকআপ। সর্দি, কাশি, বুকে চাপ, শ্বাসকষ্ট এসব হলে অবশ্যই কোভিড টেস্ট আর ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এজন্য কাছের হাসপাতাল ক্লিনিকের ফোন, হেল্পলাইন, তাঁদের কম্যুনিকেশন অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ, এসব করবেন ঘরের অন্যরা। আর তাঁদের মন যাতে ভালো থাকে সে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাদের কাছে বসা, কথা বলা, চাহিদা জানা এসব খুব দরকার।
বেলাশেষে দায়ভারহীন জীবনের কথা ভেবে আসতে পারে মানসিক বিপর্যয়। যদি তাঁরা ভাবেন, আমি বাতিলের দলে তাহলে তাঁদের দু:খের ভার আরও বাড়বে। যদি এমন পরিস্থিতি করে দেওয়া যায় যে, অবসর জীবন আনন্দে কাটবে জীবন তাহলে মন ভালো হবেই।
‘অমল ধবল পালে যখন লাগে মন্দ মধুর হাওয়া
তখন যেন বিপুল আনন্দে হয় জীবনতরি বাওয়া।’
বিশ্বের জনগণনার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছাবে ৯০০ কোটিতে। আর এর অর্ধেক হবেন প্রবীণ নাগরিক। এর অর্ধেক হবেন গ্রামবাসী। বয়স্কদের রোগ ভোগের ঝুঁকি বেশি আর করোনা ঝুঁকিও বেশি। সেই ঝুঁকি আরও প্রবল হয় যখন তাঁদের কোনো ক্রনিক রোগ থাকে।
কেবল শরীর নয়, মনের স্বাস্থ্য থাকে ঝুঁকিতে। আর বিষণœতা হলো সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। এজন্য কেবল পরামর্শই নয়, দরকার উপযুক্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদেও কাউন্সেলিং এবং সে সঙ্গে প্রয়োজন চিকিৎসা। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস, অষ্টিওপোরোসিস, প্রোস্টেট, ক্যানসার, হাপানি, সিওপিডি কিংবা হতে পারে মূত্রবদ্ধতা। তাই রোগী একটি রোগ নিয়ে গেলেও অন্য রোগও থাকতে পারে এ কথা মাথায় রাখবেন চিকিৎসক।
বুকে ব্যাথা, চাপ ধরা ভাব, কুলকুল ঘেমে শরীরে হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ। আবার তেমন সব উপসর্গ ছাড়া হার্ট অ্যাটাক হওয়াও অসম্ভব নয়। হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক। বয়স্কদের এমন হয়। হঠাৎ অসংলগ্ন খাপছাড়া কথাবার্তা, অদ্ভুত আচরণ। ইলেক্ট্রোলাইট ইম্বেলেন্স তাঁদের মধ্যে হয় অনেক সময়। প্র¯্রাবে সংক্রমণ হলেও হতে পারে এমন। আর একটি কথা, ছোটোখাটো স্বাস্থ্যসমস্যা হঠাৎ জটিল হয়ে ওঠা তাঁদের ক্ষেত্রে খুব সম্ভব। বয়স্ক হলে আরেক সমস্যা, স্মৃতি আর বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা। এজন্য ডিমেনশিয়া, আলঝেইমার রোগ, পারকিন্সন্স ডিজিজ হতে পারে। স্ট্রোক বা ডিমেনশিয়াতে বয়স্কদের নিজের নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। আর সেজন্য বিছানায় প্র¯্রাব পায়খানা হতে পারে। এ অবস্থায় সংসারের লোকজনের মুখ ঝামটা গালমন্দ তাঁদের মনে আরো বিষণœতা এনে দেয়।
ভালো থাকতে চাই তাঁদের জন্য সুষম আহার আর শরীরচর্চা। হাঁটাহাঁটি আর প্রাণায়াম। আর সৃজনশীল মানসিক কাজে থাকলে মগজ থাকে তরুণ। এজন্য চাই তাঁদের দেখভাল।
বিষণœতা হয় বয়স্কের সঙ্গী। লকডাউনের সময় এই সমস্যা হচ্ছে তীব্র। ঘরে একা থাকা। সামজিকভাবে বিচ্ছন্ন। নাতনীকে আদর করে কোলে তুলে নেওয়া হচ্ছে না। হেঁটে হেঁটে সকালে বাজারে যাওয়া, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, পার্কে হাঁটা; এসব হচ্ছে না। এদিকে টেলিভিশনে শুধুই ভয়ের খবর। কম্পিউটারে, হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে তাঁরা অত অভ্যস্ত নন। তাহলে? মন কী করে থাকবে ভালো?
বাড়ি থেকেই প্রবীণদের সামাজিক যোগাযোগ বাড়াবার কৌশল শেখানো যায়। দূরে নাতি নাতনি থাকলে তার সাথে ভিডিওচ্যাটে কথা বলা যায়। কথা বলা যায় ছেলে মেয়েদের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গেও। আর সব সময় টেলিভিশনে সংবাদ না শুনে বিনোদন অনুষ্ঠান দেখবেন, শুনবেন হারানো দিনের গান। একটু বাগানে সময় কাটালে ভালো। ঘরের টুকটাক কাজ নয় কেন! শখ থাকলে করুন শখের কাজ। বাদ্যযন্ত্র বাজালেন। সূচিকর্ম করলেন। ছবি আঁকলেন। লেখালেখি বা বই পড়ে সময় কাটাতে পারেন।
আবার বিষণœতাকে হাল্কাভাবে দেখা ঠিক না। একাকীত্ব, আর্থিক কষ্ট, অসহায়ত্ব, সমাজের চাপে হতে পারে বিষণœতা। মেধাবি ছেলে পরীক্ষায় ভালো করেনি, ব্যবসায় মন্দা, কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা, ব্যক্তিগত জীবনে অপ্রাপ্তি, পারিবারিক অশান্তি, সন্তান মানুষ হলো না; এরকম কারণেও হয় বিষণœতা, অবসাদ এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টা। এজন্য স্বজনরা তাদের খোঁজখবর নেবেন, সান্ত¡না দেবেন।
বৃদ্ধ মানে এক টুকরো ছাদ। মাথার উপর বিশাল আকাশ। বয়স্ক বাবা বা মা যতটা না গুরুজন তারচেয়ে বেশি হয়ে উঠতে পারেন বন্ধু। অনেক সময় তাদের সান্নিধ্য দেয় নিশ্চিন্তিপুরের সন্ধান।
আমরা তাঁদের মনকে অন্য কাজেও ব্যস্ত রাখতে পারি। অলস বসে না থেকে কাজের মধ্যে থাকা মনকে ভালো রাখে। ঘরে প্রাত্যহিক কর্ম করা, একটু বাগান পরিচর্যা করা, স্বামী স্ত্রী দুজনে একত্রে বসে প্রাতরাশ করা কিংবা পাখি উড়ে এলে খেতে দেওয়া; এই কাজগুলো মনকে আনন্দে রাখে। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে পারেন। রান্নার অভ্যাস থাকলে রান্না করুন।
আবার মন খারাপ মানেই বিষণœতা নয়। টানা দু সপ্তাহ মন খারাপ থাকা, আগে যেসব কাজ ভালো লাগত সেগুলো ভালো না লাগা, দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ, ঘুম না হওয়া বা বেশি হওয়া, খাবারে অরুচি, নিজেকে সবকিছুতে দায়ী মনে করা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা; এমন সব লক্ষণ হলো বিষণœতা। বয়স্কদের ২০% অবসাদে ভোগেন। নিঃসঙ্গতা, অসহায় অবস্থা, উদ্বেগ, করোনা আতঙ্ক সব মিলেমিশেই আনে অবসাদ। করোনাকালে তাদের শরীর মন দুটোর ঝুঁকিই বেশি।
তাই স্বজনদের দেখভাল লাগবে। ওষুধের জোগান যেন ঠিক থাকে। বাসায় থাকবে পালস অক্সিমিটার, গøুকুমিটার, ওজন মাপার মেশিন, রক্তচাপ মাপার মেশিন, তাপমান মাপার মেশিন। আর ইমারজেন্সি কল হেল্পলাইন নম্বর, ডাক্তারদের নম্বর, অ্যাম্বুলেন্স, কোভিড টেস্ট কেন্দ্রের নম্বর প্রয়োজনে কাজে লাগবে। টেলিমেডিসিন নম্বর রাখতে হবে। সকাল সন্ধ্যা হাঁটা, যোগাসন, ব্রিদিং এক্সারসাইজ, স্ত্রেচিং, ধ্যানচর্চা; এগুলো নিয়মিত করুন। আর ক্রনিক ডিজিজ থাকলে
চেকআপ করতে হবে।
যৌবন ভোগের কাল, বার্ধক্য স্মৃতিচারণের; তার বদলে যেন বার্ধক্য হয় উপভোগের। প্রতিটি বয়সের একটি নিজস্ব আনন্দ আছে। বয়সীরা যেন তা পান। যেমনটি বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘যৌবনের শেষে শুভ্র শৎরকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সুন্দর বয়স আসে যখন জীবনের শেষে ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময়।’
আমরা তেমন শুভ্র সুন্দর আনন্দময় বয়স্ক কালের প্রত্যাশায়।
——————————————————————————————————————————————————
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
ডিন, চিকিৎসা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা