নারীর অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কারণ ও চিকিৎসা

নারীর অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কারণ ও চিকিৎসা

ঘটনা-১: ফাইজা রহমানের বয়স ৩৮ বছর। একটি বেসরকারি ব্যাংকে নয়টা-পাঁচটা অফিস করেন। দীর্ঘদিন ধরে দিনের লম্বা একটা সময় চেয়ারে বসে কাজ করার কারণে পিঠ ও কোমরে বেশ ব্যথা দেখা দিয়েছে। ব্যথার মাত্রা দিনদিন এতটাই বেড়েছে যে, স্বাভাবিকভাবে ওঠাবসা করতেও অসুবিধা হচ্ছে। তিনি দ্রুত একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারেন তার মেরুদণ্ডের হাড়ক্ষয় হয়েছে। এ কারণেই কোমর ও পিঠে তীব্র ব্যথা অনুভব করছেন তিনি।

ঘটনা-২: বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন রানু আকতার। প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি বয়সী রানু পনেরো বছর যাবৎ একটানা কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন চারটা বাসায় সিঁড়ি ভেঙে কাজে যান তিনি। ঝাড়ু-ঘরমোছা, রান্নাসহ যাবতীয় কাজ করেন। ইদানীং ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। কোথাও বসলে স্বাভাবিকভাবে উঠতে পারছেন না। আবার উঠলে বসতে পারছেন না। সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করতেও অসুবিধা হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। জানতে পারেন তার হাড়ক্ষয় হয়েছে।

উপরের দুজন নারীর হাড়ক্ষয়জনিত এই সমস্যাকে বলা হয় অস্টিওপোরোসিস। এই রোগে আক্রান্ত হলে হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় ছিদ্রযুক্ত হতে পারে। দুর্বল হয়ে ভেঙ্গেও যেতে পারে। সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা না করা হলে ব্যক্তিগত কাজ যেমন—নামাজ, গোসল, টয়লেট এমনকি স্বাভাবিক হাঁটাচলা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অস্টিওপোরোসিস কী?

মানুষের শরীরের হাড়ের একটি বিশেষ গঠনপ্রক্রিয়া আছে। জন্মের পর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হাড় নানাভাবে পরিপক্ব হতে থাকে। এরপর আবার ভিটামিন-ডি, ক্যালসিয়াম ও হরমোনের ঘাটতিসহ নানা কারণে হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় পাতলা হতে শুরু করে। শরীর সবসময় পুরনো বা ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু সরিয়ে নতুন টিস্যু তৈরির মাধ্যমে শরীরের কাঠামো ঠিক রাখে। চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকে শরীরে টিস্যু তৈরির পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুর জায়গা ভরাট না হওয়ায় শরীরের হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং ক্ষয় হতে থাকে। একসময় অল্প আঘাতেই ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়, যাকে অস্টিওপোরোসিস বলা হয়।

কেন হয় অস্টিওপোরোসিস?

অস্টিওপোরোসিস একটি নীরব ঘাতক। অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তিনি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন কারণে অস্টিওপোরোসিস হতে পারে। এই রোগের প্রধান কারণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি’র অভাব। ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া, দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ওষুধ সেবন, ধূমপান, দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ, উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার কম খাওয়া, দীর্ঘ সময় বসে থাকা, রোদ এড়িয়ে চলা, অতিরিক্ত চা-কফি ও মদ্যপানসহ নানা কারণে এটি হতে পারে।

এছাড়া যারা ক্যানসার, রক্তরোগ, অপুষ্টিজনিত রোগ ও কিডনি রোগে আক্রান্ত তাদের হাড়ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। সাধারণত যেসব বয়স্ক পুরুষ বহুদিন যাবৎ স্টেরয়েড ওষুধ সেবন করেন তাদের এবং মহিলাদের মনোপজের পর এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।

কেন নারীদের অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বেশি?

চল্লিশোর্ধ্ব নারীরা অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের ইস্ট্রোজেন এবং পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে মেয়েদের মাসিক বন্ধ হলে অর্থ্যাৎ মেনোপোজের পর এটি বেশি হয়। ইস্ট্রোজেন হরমোন নারীদের হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখে। মেনোপজের পর এই হরমোনের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমতে শুরু করে। আর হরমোন কমে গেলে শরীর থেকে দ্রুত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি বের হয়ে যায়। এ দুটো উপাদান কমে গেলে শরীর আর হাড় গঠন করতে পারে না, তখন শুরু হয় হাড়ক্ষয়।

ফলে মেনোপজের ১০ বছর পর হাড়ে সামান্য চোট পেলেই তা অনায়াসে ভেঙে যায়। এক্ষেত্রে কোমর, কবজি, হাঁটু, শিরদাঁড়া এই অংশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

চিকিৎসা ও সচেতনতা

অস্টিওপোরোসিস রোগে হাড়ে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। ধীরে ধীরে হাড়ের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয়ে যায়। ক্রমেই হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ফলে হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। এটি নীরবে ক্ষতি করতে থাকে। এই রোগের লক্ষণ শুরুতে বোঝা যায় না। অস্টিওপোরোসিস থেকে বাঁচতে জীবনযাত্রায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রতিদিন ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডি ও আঁশযুক্ত সুষম খাবার খেতে হবে। নিয়মিত শরীরে রোদ লাগাতে হবে। শরীরচর্চা ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে। দুধ, ছানা, দই প্রভৃতি দুগ্ধজাতীয় খাবার খেতে হবে। ডিম, ডাল, সয়াবিন, পালংশাক, সরিষাশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, খেজুর, বাদাম, সামুদ্রিক মাছ ও মাংসজাতীয় খাবার খেলে এই রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।

সাধারণত মানুষের জন্মের পর থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত হাড়ের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। আবার ৪০ বছরের পর থেকে প্রাকৃতিকভাবেই এই ঘনত্ব কমতে থাকে। অর্থাৎ, হাড়ক্ষয় হতে থাকে। কিন্তু এই হাড়ক্ষয় হতে থাকে নীরবে। হাড় বা অস্থি ভাঙার আগে বোঝা যায় না। সেক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিয়মিত হাড়ের ডেনসিটি পরীক্ষা করতে হবে।


ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম সোহান

এমবিবিএস, ডিএম, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি, বারডেম)
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp