নারীর মেনোপজ : কী ধরনের প্রভাব ফেলে মন ও শরীরে
যখন প্রথমবার পিরিয়ড শুরু হয়, তাকে বলা হয় মেনার্কি। আর যখন পিরিয়ড স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তার নাম মেনোপজ। সাধারণত ৪৬ থেকে ৫২ বছরের মধ্যে নারীদের মেনোপজ হয়। আবার কারো কারো ৪০ বছরের আগেই মেনোপজ হতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় প্রিম্যাচিউর ওভারিয়ান ফেইলিওর। মেনোপজ একজন নারীর জীবনে খুবই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু মন ও শরীরে রয়েছে এর ব্যাপক প্রভাব। খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের স্বল্পতা, হাড়ক্ষয় রোগসহ শরীরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এ সময়।
মেনোপজের ধরন
স্বাভাবিক মেনোপজ
সাধারণত ৮ থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে একটি মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করে। এ সময় তার মাসিক শুরু হয়। আর ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে তা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে গড়ে ৫১ বছর বয়সে স্থায়ীভাবে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। একটি কন্যাশিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখনই তার ডিম্বাশয়ে প্রায় ৭০ লাখ ডিম্বাণু থাকে। জন্মের সময় তা কমে গিয়ে ১০-১২ লাখে পৌঁছায়। আর কিশোরী বয়সে তা নেমে আসে ৩-৫ লাখে। এভাবে ক্রমশ ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর সংখ্যা কমতে থাকে। পূর্ণ বয়স হলে যখন মাসিক শুরু হয়, তখন প্রত্যেক মাসে তা নিষিক্ত হতে থাকে। আবার অনেক ডিম্বাণু না ফুটেই নষ্ট হয়ে যায়। নিষিক্ত হওয়া ডিম্বাণু থেকেই মেয়েদের হরমোন তৈরি হয়। বয়স যত বাড়তে থাকে, ডিম্বাণুর সংখ্যা ততটাই কমতে থাকে। তাছাড়া বয়সের একটা পর্যায়ে এসে অবশিষ্ট ডিম্বাণু আর নিষিক্ত হতে পারে না। নারীদেহের এমন শারীরিক পরিবর্তন ও অবস্থাকে স্বাভাবিক মেনোপজ বলা হয়।
কৃত্রিম মেনোপজ
কোনো কারণে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নারীর ২টি ওভারি অথবা জরায়ু ফেলে দেওয়া হলে, পিরিয়ড স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা কেমোথেরাপির কারণে যদি ডিম্বাশয়ের রক্তসঞ্চালন কমে যায়, তাহলেও মেনোপজ হতে পারে।
মন ও শরীরে মেনোপজের প্রভাব
হাড়ক্ষয় রোগ
মেনোপজের কারণে নারীর হাড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এ সময় হাড়ের ক্যালসিয়াম কমতে শুরু করে। এতে হাড় দুর্বল হয়ে যায়। বিশেষ করে কোমর ও কোমরের নিচের দিকের হাড় খুবই দুর্বল হয়ে যায়।
বেশির ভাগ নারীই মেনোপজের পর কোমরের ব্যথায় ভুগে থাকেন। কারো মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়, সামনের দিকে শরীর ঝুঁকে পড়ে। এ কারণে বাঁকা হয়ে হাঁটতে দেখা যায় অনেক নারীকে। এ ছাড়া হাঁটু ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথাসহ বিভিন্ন জায়গায় হাড়ের ব্যথা হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় অস্টিওপরোসিস।
ব্যথাযুক্ত সহবাস
মেনোপজের কারণে যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যায়। তাই যৌনমিলনে নারী তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হরমোনের ওষুধ সেবন ও ক্রিম হিসেবে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
হটফ্লাশ
মেনোপজের সময় আকস্মিকভাবে আগুনের হল্কার মতন শরীরে গরম অনুভূত হওয়া, রাতের বেলায় ঘাম হওয়া, ঘুম না হওয়া, দুশ্চিন্তা হওয়া, মনমরা ভাব এবং যৌনমিলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার ঘটনা অতি সাধারণ।
দ্রুত প্রতিক্রিয়া
মেনোপজের পর নারীদের মধ্যে দ্রুত প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক হতে পারে। যেমন হুটহাট রেগে যাওয়া, অল্পতে কেঁদে ফেলা ইত্যাদি।
যৌনাঙ্গ ও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া
প্রজননতন্ত্রে ইস্ট্রোজেনের অভাবে যোনিপথ শুকিয়ে যায়। এ ছাড়া এ সময় হরমোনের অভাবে জরায়ু নিচে নেমে আসে। মেনোপজের সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাও কমে যায়। যার ফলে ঘন ঘন যৌনাঙ্গে নানা সংক্রমণ ও প্রস্রাবের প্রদাহ দেখা দেয়।
বিষণ্নতা ও মানসিক অবসাদ
ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে শরীরের ত্বক কুঁচকে যায়, দ্রুত চুল পড়ে ও চেহারার লাবণ্যতা কমে আসে। এ সময় নারীদের মধ্যে বিষণ্নতা জেঁকে বসে।
ভুলে যাওয়া বা মনোযোগ হারানো
এ সময় একজন নারীকে অসংখ্য শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তা ছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও কমতে থাকে। ফলে কোনো কিছু ভুলে যাওয়া বা মনোযোগ হারানোর মতো নানা পরিবর্তন দেখা দেয়।
কারো কারো দাড়ি-গোঁফ গজায়
মেনোপজের পর শরীরের বিভিন্ন হরমোনের ঘাটতি অথবা আধিক্য ঘটে। পুরুষ হরমোন (অ্যান্ড্রোজেন) প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায় কিন্তু ইস্ট্রোজেন বেশি কমাতে অ্যান্ড্রোজেনের কিছুটা আধিক্য হয়। তার ফলে মেনোপজের পরে অনেক নারীর মুখে অল্প কিছু দাড়ি ও গোঁফের রেখা দেখা দিতে পারে।
দ্রুত ওজন বৃদ্ধি ও হৃদ্রোগ
মেনোপজের পর শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। ফলে অনেক নারী দ্রুত মুটিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় রক্তে চর্বি বাড়ে, বাড়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। অনেকের বুক ধড়ফড় করে, রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারেন না এবং ঘুমের মধ্যে প্রচণ্ড ঘাম দেখা দেয়।
“মেনোপজ একজন নারীর শরীর ও মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই এ সময় জীবন যাপনে বিশেষ যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।“
মেনোপজে করণীয়
- মেনোপজ দীর্ঘ মেয়াদে হাড়ক্ষয় ও হৃৎপিণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি নিতে পারেন।
- তেল ও অধিক চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
- শরীরে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম না থাকলে মেনোপজ-পরবর্তী সময়ে অস্টিওপোরোসিস জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই খাদ্যতালিকায় রাখুন ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার।
- ফাইটোইস্ট্রোজেন-সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমন—সয়া, তিল, বাদাম, মেথি, ফুলকপি, ব্রকলি, বাঁধাকপি। ড্রাই ফ্রুটস—যেমন খেজুর, অ্যাপ্রিকট ইত্যাদি।
- চুল পড়া ও ত্বকের লাবণ্যহীনতা কমাতে ভিটামিন ই-যুক্ত খাবার খেতে হবে। যেমন— সয়াবিন, বাদাম, অঙ্কুরিত সবজি, ডিম ইত্যাদি।
- সেলেনিয়াম হট ফ্লাশ কমায়। কলিজা, টুনা মাছ, টমেটো, পেঁয়াজ, ব্রকলি, রসুন ইত্যাদিতে সেলেনিয়াম আছে। এসব খাবার খেতে পারেন।
- দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন।
ডা. নায়ার ইসলাম (বিন্দু)
এমবিবিএস, এমসিপিএস (গাইনি),
এফসিপিএস (গাইনি)
কনসালট্যান্ট,
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন,
ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিকস, খুলনা