এ সময়ে শিশুর জ্বর: নিউমোনিয়া নয় তো?
রুবিনা আখতার তার দেড় বছর বয়সী শিশু মিমিকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। সকালে হঠাৎ তীব্র জ্বর এসেছিল মিমির। দুপুরের দিকে জ্বরের পাশাপাশি দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বুকের পাঁজর দেবে যাচ্ছিল। মেয়ের এই অবস্থা দেখে বেশ ঘাবড়ে যান তিনি। তাই দ্রুত মেয়েকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসক জানিয়েছেন, মিমি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে আসায় ঝুঁকি অনেকটাই কেটে গেছে। তার এখন সুচিকিৎসা প্রয়োজন।
নিউমোনিয়া কি?
ফুসফুসের প্রদাহজনিত একটি সংক্রামক রোগ নিউমোনিয়া। ইংরেজিতে একে বলা হয় রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (Respiratory tract infection)। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফাঙ্গাসের মাধ্যমে এটি দেহে প্রবেশ করে। হাঁচি–কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। ফলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে কাশি বেড়ে যায়। বিশ্বজুড়ে নিউমোনিয়া সব বয়সী মানুষের জীবাণুঘটিত মৃত্যুর বড়ো কারণ হিসেবে চিহ্নিত। শিশুদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো এটি মারাত্মক হয়ে ওঠে। নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
নিউমোনিয়ার লক্ষণ
দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের শ্বাস নেওয়ার হার মিনিটে ৬০ বারের বেশি, ২ মাস থেকে ১২ মাস বয়সী শিশুদের মিনিটে ৫০ বারের বেশি এবং ১২ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুর মিনিটে ৪০ বারের বেশি হলে তাকে শ্বাসকষ্ট বলা হয়। এর সঙ্গে শিশুর বুকের পাঁজরের নিচের অংশ দেবে গেলে, তা নিউমোনিয়ার অন্যতম লক্ষণ।
- তীব্র বা মাঝারি মাত্রার জ্বর
- কাশি ও শ্বাসকষ্ট
- শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া
- খাবারে অনীহা
- শিশুর শরীর নীল বর্ণ ধারণ করতে পারে
- ঘাম, অস্বস্তি ও ডায়রিয়া হতে পারে
- বমি হতে পারে
- খিঁচুনি ও শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে পারে

নিউমোনিয়া ছোঁয়াচে নয়।
তবে রোগীর কাশি বা হাঁচি
থেকে এই রোগের জীবাণু
ছড়াতে পারে। একে ‘ড্রপলেট
ইনফেকশন’ বলা হয়।
যেসব শিশুর ঝুঁকি বেশি
শীতে শিশুদের সাধারণ জ্বর-সর্দি- কাশি অনেক বেড়ে যায়। তবে সাধারণ জ্বর ও নিউমোনিয়ার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু পার্থক্য। সাধারণ জ্বরে শিশুর সর্দি কাশি থাকলেও শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয় না। কিন্তু নিউমোনিয়া হলে শিশুর শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হলে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যেসব শিশুর নিউমোনিয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি—

- অপুষ্টির শিকার ও নবজাতক শিশু।
- রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম যাদের।
- জন্মগত হৃদরোগ বা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত শিশু।
- বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত শিশু।
- ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে বাস করে যারা।
- অতিরিক্ত ভিড় ও বায়ুদূষণে অবস্থান করে যারা।
- পরোক্ষ ধূমপানের শিকার শিশু।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা
নিউমোনিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতার মাধ্যমে এটি প্রতিহত করা সম্ভব। সাধারণত উপসর্গের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে নিউমোনিয়াকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়।
- খুব মারাত্মক
- মারাত্মক
- সাধারণ নিউমোনিয়া
সাধারণ নিউমোনিয়ার চিকিৎসা বাড়িতেই করা সম্ভব। মারাত্মক বা খুব মারাত্মক লক্ষণগুলো না থাকলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি না করেও চিকিৎসা করা যায়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না।
এ সময় শিশুর খাবারের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। কাশি হলে বুকে তেল মালিশ করার প্রয়োজন নেই। অহেতুক সাকশন যন্ত্র দিয়ে কফ পরিষ্কার বা নেবুলাইজার ব্যবহার করাও ঠিক নয়। শিশুর সংকটাপন্ন অবস্থা যেমন—শ্বাসকষ্ট, বমি, খিঁচুনি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ
মারাত্মক নিউমোনিয়ায় শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তাই নিউমোনিয়া প্রতিরোধ সবচেয়ে জরুরি। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন ও সচেতনতাই যথেষ্ট।
- শিশুর জন্মের পর এক ঘণ্টার মধ্যে শালদুধ খাওয়ান।
- অন্তত ছয় মাস শিশুকে নিয়মিত মায়ের দুধ দিন।
- বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- শিশুকে চুলার ধোঁয়া, মশার কয়েল ও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে দূরে রাখুন।
- শিশুকে সময়মতো নিউমোনিয়ার টিকা দিন।
- নবজাতকের মায়েদের পুষ্টিকর খাবার খেতে দিন।

অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান
এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি (পেডিয়াট্রিক)
এমডি (নিওন্যাটোলজি)
ফেলো নিওন্যাটোলজি, এনইউএইচ (সিঙ্গাপুর)
এক্স-চেয়ারম্যান, নিওন্যাটোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ঢাকা
শিশু ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।