বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু রোগ শরীরে এসে ভর করে। আবার অনিয়মিত জীবনযাপন এ রোগেগুলোকে দ্রæত বাড়তে দেয়। নিজে সচেতন হলে এবং তথ্যগুলো জানা থাকলে এসব জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আজকের আয়োজন এমন কিছু রোগ নিয়ে যার সঙ্গে আপনি পরিচিত। তথ্যগুলো জেনে এবার তাদের প্রতিহত করুন।
নিদ্রাহীনতা
সারারাত ঘুমোতে পারেন না কেউ কেউ। একবার যদি কোনোভাবে ঘুম ভেঙ্গে যায়, আর ঘুম আসে না। ঘুম সম্পূর্ণ না হওয়ায় সারাদিন অত্যন্ত ক্লান্তিবোধ করেন। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। বিঘিœত হয় দৈনন্দিন কার্যকলাপ। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ঘুম না হওয়ার এ সমস্যাকেই বলে নিদ্রাহীনতা বা ইনসোমনিয়া।
নিদ্রাহীনতার প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরা হয় মানসিক চাপকে। কিন্তু এগুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু কারণে একজন মানুষের স্বাভাবিক ঘুমের চক্রের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যেমন- অতিরিক্ত চা, কফি খাওয়া, ডিভাইসে আসক্তি, এ্যালকোহল পান, ধূমপান, অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অতিরিক্ত কাজের চাপ, পরিবেশগত কারণ ইত্যাদি।
নিদ্রাহীনতার সমস্যা এড়াতে সবার আগে যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে জীবনধারায় পরিবর্তন আনা। যেমন- মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি কমানো, সন্ধ্যার পর কোনো প্রকার চা, কফি বা এলকোহল গ্রহণ না করা, প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট কার্যতালিকা অনুসরণ করা, ব্যায়াম করা,
মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকা ইত্যাদি। টানা দু সপ্তাহ যদি কারো নিদ্রাহীনতার সমস্যা দেখা যায় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ গ্রহণ করা যাবে না।
গেঁটে বাত
গেঁটে বাত এমন একটি রোগ যেটি শুধু ভোগায়ই না বরং বলা হয়ে থাকে এটি রোগীর আর্থিক অবস্থা সম্পর্কেও একটি ধারণা দিয়ে থাকে। কেননা, এটি কোনো অপুষ্টিজনিত রোগ নয়। উপরন্তু যাদের দৈনন্দিন
খাদ্যতালিকায় খাসির বা গরুর মাংস, শিম, মটরশুটি জাতীয় খাবার, মাশরুম, মাছের ডিম থাকে তারাই গেঁটে বাতের শিকার হয়ে থাকে। অর্থাৎ রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা অস্থিসন্ধিতে জমা হয়ে প্রদাহের সৃষ্টি করলেই গেঁটে বাত হয়।
গেঁটে বাত হলে সাধারণত পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে অতিরিক্ত ব্যথা হয়, ফুলে যায় বা লাল হয়ে যায়। এছাড়া হাঁটু, গোড়ালি, কাঁধ, হাত কনুইসহ যেকোনো অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হতে পারে বা ফুলে যেতে পারে।
একটু সচেতন থাকলেই এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। যেমন- প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রোটিনযুক্ত খাবার না খাওয়া,
শাকসবজি-ফলমূল বেশি খাওয়া, মদ্যপান ও ধূমপান থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি।
টানা দু সপ্তাহ যদি কারো নিদ্রাহীনতার সমস্যা দেখা যায় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শয্যা ঘা
শয্যা ঘা এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী অসুখ। সাধারণত অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন একটানা বিছানায় পড়ে আছে এমন মানুষদের এ রোগ হয়ে থাকে। তাই রোগীর জন্য বেডশোর বা শয্যা ঘা কিছুটা গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতোই। দীর্ঘসময় ধরে একটানা চাপের কারণে হাড়ের উপরের ত্বকে সৃষ্ট ঘাকেই শয্যা ঘা বলে।
এ রোগ প্রতিরোধে রোগীকে টানা শুয়ে থাকতে নিষেধ করতে হবে। ঘনঘন পাশ ফিরিয়ে দিতে হবে। নরম বিছানা ও মসৃণ বিছানার চাদর ব্যবহার করতে হবে। যেসব স্থানে বিছানার সাথে ঘর্ষণ বেশি হয় সেসব স্থানে হাড়ের নিচে নরম বালিশ বা গদি দেওয়া যেতে পারে।
কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ
অনেকসময় দেখা যায়, কোনো প্রকার উৎস ছাড়াই কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ অথবা কোনো গুঞ্জনের মতো শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের সমস্যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে টিনিটাস। তবে এটি কোনো রোগ নয়, বরং রোগের উপসর্গ মাত্র। মানুষের শ্রবণব্যবস্থায় কোনো প্রকার অস্বাভাবিকত্বের সৃষ্টি হলেই এ জাতীয় সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে।
টিনিটাস সাধারণত বয়স্কদের হয়ে থাকে। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন- কানে সংক্রমণ, সাইনাসে সংক্রমণ, হরমোনের পরিবর্তন, থাইরোয়েড সমস্যা, কানে আঘাত, অবসাদ, ময়লা জমে কানের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া, ওষুধের পার্শ্বপতিক্রিয়া ইত্যাদি।
টিনিটাস সাধারণত নিজে নিজেই সেরে যায়। এর জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে এটি যদি কানের অন্য কোনো সমস্যার কারণে হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
কালো রাজার ঘা
অনেকসময় আমাদের চোখের পাতা ফুলে যায়। এসময় চোখের আশপাশের অঞ্চলে ব্যথা হয় এবং বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত এই যন্ত্রণা সহ্য করা লাগে। যেসব কারণে এ সমস্যা হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম চোখের কর্নিয়ায় ঘা হওয়া। এ অসুখের আবার গালভরা নামও রয়েছে, ‘কালো রাজার ঘা’। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘কর্নিয়াল আলসার’।
বিভিন্ন কারণেই চোখে ঘা হতে পারে। যেমন- কোনোভাবে চোখে আঘাত লাগা। সাধারণত ধান কাটার মৌসুমে চোখে ধানের পাতার আঘাতে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। এছাড়া- অপুষ্টি, ভিটামিন এ’র অভাব, চোখের সংক্রমণ থেকে, চোখ অপরিষ্কার থাকলে, চোখের নালি বন্ধজনিত সমস্যা থেকেও চোখে ঘা হতে পারে।
এ জাতীয় সমস্যায় সাধারণত আলোতে চোখ খুলতে অস্বস্তি হয়। এছাড়া চোখে অসহ্য ব্যথা হয়, চোখ লাল হয়ে যেতে পারে, চোখ থেকে পানি পড়তে পারে, আবার অনেক সময় চোখের মণিতে দাগ ও সাদা সাদা ঘা স্পষ্ট হতে পারে।
কর্নিয়াল আলসার বা চোখের ঘা এড়াতে চোখে আঘাত লাগতে পারে এমন পেশায় যারা জড়িত তারা চশমা ব্যবহার করতে পারেন। কোনো অবস্থাতেই চোখ ঘষা যাবে না। সবসময় চোখ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং চোখের যেকোনো সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
——————————————————————————————————————————————————
ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার
ব্যবস্থাপক
মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স
ল্যাবএইড হাসপাতাল