নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন জরুরি
-ডা. জুবায়ের আহমদ
সুইটি জামান, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কাজের চাপে নিজের শারীরিক ও মানসিক যত্ন নিতে ভুলে যান। হালকা মাথাব্যথা বা বমিভাব হলেও কখনো এসব ছোটোখাটো অসুস্থতাকে পাত্তা দেন না, নিজেকে সব সময় কর্মব্যস্ত রাখেন। কিছুদিন যাবৎ তিনি ঘাড়ের পেছনে ও মাথায় অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব করছিলেন। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে ভেবে ব্যথা শুরু হওয়ার পর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যান। বাসায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাড়তে থাকে ব্যথা ও অস্বস্তি। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরে পৌঁছার আগেই অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালের বিছানায়। স্ট্রোক করেছেন সুইটি জামান।
উপরের ঘটনাটি হরহামেশাই ঘটছে আমাদের চারপাশে। অসুখের উপসর্গকে পাত্তা না দেওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে অনেক বেশি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ও নিজের শরীরের খোঁজখবর রাখার মতো জরুরি কাজটা আমরা ভুলে যাই। পরবর্তীকালে জেঁকে বসে বড়ো ধরনের রোগবালাই।
যেসব পরীক্ষা নিয়মিত করা প্রয়োজন

উচ্চ রক্তচাপ: সাধারণত চল্লিশের পর উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে, উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে যেকোনো বয়সেই। উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি জটিলতাসহ নানান সমস্যা হতে পারে।
রক্তে শর্করা: রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, স্ট্রোক, অন্ধত্ব, হৃদ্রোগসহ নানান ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে নিয়মিত রক্তে শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা করা দরকার।
চক্ষু পরীক্ষা: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। চোখে ছানি পড়াসহ নানান সমস্যা দেখা দেয়। গ্লুকোমা হলে চোখের অপটিক নার্ভ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীকালে দেখা দেয় দৃষ্টিহীনতা। তাই চল্লিশের পর বছরে একবার চক্ষু পরীক্ষা করাতে হবে।
লিপিড প্রোফাইল: উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে এবং বয়স ৩৫-এর বেশি হলে বছরে অন্তত একবার রক্তের লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করাতে হবে।
ক্যানসার স্ক্রিনিং: ক্যানসারজনিত মৃত্যুর অন্যতম কারণ কোলোরেক্টাল ক্যানসার। এই রোগের উপসর্গ প্রাথমিক অবস্থাতে বোঝা যায় না। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে লক্ষণ প্রকাশ পায়। তখন আসলে আর কিছুই করার থাকে না। তাই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে পরীক্ষাটি করাতে হবে। চল্লিশের পর পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসার ও নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার পরীক্ষা করা খুবই জরুরি।
হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা: বয়স চল্লিশ পেরুলেই অস্টিওপোরেসিস, আর্থ্রাইটিসসহ হাড়ের নানান রোগ দেখা দিতে শুরু করে। হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ঘনত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে হাড়ের রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়।
দাঁতের পরীক্ষা: দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্ম বোঝে না-প্রচলিত এই প্রবাদটি মিথ্যা প্রমাণ করতে আমাদের সবার উচিত দাঁতের যত্ন নেওয়া। দাঁতের পরীক্ষায় ফাঁকি না দিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা করা ও চিকিৎসার মাধ্যমে দাঁতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
স্থূলতা বা ওবেসিটি: স্থূলতার কারণে নানা ধরনের সমস্যা ও রোগবালাই দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। নিয়মিত রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষার মাধ্যমে এ ধরনের মানুষের হঠাৎ আসা স্বাস্থ্যগত বিপদ এড়ানো যায়।
যাদের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে বা নিয়মিত চশমা ব্যবহার করতে হয়,
তাদের ছয় মাস অন্তর হলেও চক্ষু পরীক্ষা করা জরুরি।
নারীস্বাস্থ্য রক্ষায় পরীক্ষা

ঘরে কিংবা বাইরে সব জায়গায় বেড়েছে নারীদের কাজ। কাজের চাপে অনেক সময় নিজেদের যত্ন নিতে ভুলে যান। বয়স ত্রিশ পার হলে তারা মারাত্মক সব রোগের ঝুঁকিতে থাকেন। এ সময় প্রত্যেক নারীর উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
ম্যামোগ্রাম: স্তন ক্যানসার শনাক্ত করতে ম্যামোগ্রাম করা হয়। বিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সী প্রত্যেক নারীর দুই থেকে তিন বছর পরপর হলেও এই পরীক্ষাটি করা উচিত।
থাইরয়েড পরীক্ষা: নারীদের মধ্যে থাইরয়েডের সমস্যা আজকাল অনেক বেশি দেখা যায়। নিয়মিত থাইরয়েড পরীক্ষা করলে জটিলতা বাড়ার আগেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া, ক্লান্তি ও অবসাদ, নখ ভেঙে যাওয়া, ত্বকের শুষ্কতার মতো সমস্যা দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে থাইরয়েড পরীক্ষা করাতে হবে।

প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষা: সার্ভিক্যাল বা জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্ত করতে প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষা করা হয়। নারীদের অকালমৃত্যুর অন্যতম কারণ সার্ভিক্যাল ক্যানসার। একুশ বছর বয়সের পর প্রত্যেক নারীর এই পরীক্ষাটি করা উচিত।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুফল
- শরীরে যদি কোনো জটিল রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি শুরুতেই ধরা পড়ে। ফলে বিস্তার লাভের আগেই উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা যায়।
- অনেকের বংশগত রোগ থাকে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি পর্যবেক্ষণ করা যায়।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে মানসিকভাবে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
- আগেই রোগ ধরা পড়লে সতর্কতার মাধ্যমে জটিলতা এড়ানো যায়।
- রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে চিকিৎসার খরচ অনেকাংশে কমানো যায়।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা
আমরা বাস করছি বিষাক্ত এক পৃথিবীতে। এখানে নিত্য লেগে রয়েছে রোগবালাই। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ওবেসিটির মতো সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া, রাতজাগা, মানসিক চাপসহ জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে অল্প বয়সীদেরও নানান জটিল রোগ ঘিরে ধরছে। সুস্থ থাকতে শুধু বয়স্কদের নয়, সাতাশ থেকে সত্তর-যেকোনো বয়সীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা খুবই জরুর

ডা. জুবায়ের আহমদ
এমবিবিএস, এমডি (ইন্টারনাল মেডিসিন)
ক্লিনিকাল ফেলো-রিউম্যাটোলজি ও ইমিউনোলজি, সিঙ্গাপুর
ক্লিনিক্যাল ফেলো- পেডিয়াট্রিক ও
এডোলেসেন্ট রিউম্যাটোলজি (অস্ট্রেলিয়া ও মুম্বাই)
শিশু ও মহিলা বাত ও লুপাস বিশেষজ্ঞ
মেডিসিন, এলার্জি ও রিউম্যাটোলজি বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল