নীরব ঘাতক হাড়ের ক্যানসার

হাড় কিপটে, হাড় হাভাতে কিংবা হাড় কাঁপুনি; হাড় নিয়ে বাংলা ভাষায় রয়েছে এমন দারুণ সব উপমা, যা ব্যবহার করে আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তাকে রসবোধে পূর্ণ করে তুলি। কিন্তু এই হাড় যদি কোনো কারণে সুস্থতা হারায়, তাহলে আস্ত জীবনটাই হয়ে উঠতে পারে রসহীন, দুঃখবোধে পূর্ণ।
অন্যান্য প্রায় সব ক্যানসার নিয়েই আমাদের কমবেশি জানাশোনা আছে। আছে মোটামুটি সচেতনতাও। কিন্তু হাড়ের ক্যানসারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় খুব বেশি নেই। হাড়ে ব্যথা হলে, এমনকি সেই ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলেও ‘কোথাও আঘাত লেগেছে’ মনে করে ব্যাপারটিকে ঠিকমতো গুরুত্ব দিই না। ফলে হাড়ের ব্যথাটি পর্যাপ্ত সময় পায় ভয়াল কোনো দিকে মোড় নিতে। এমনকি এক সময় হয়ে ওঠে নীরব ঘাতক ‘ক্যানসার’।

হাড় ক্যানসারের কারণ

এ এক জটিল প্রসঙ্গ। ঠিক কী কারণে হাড়ের ক্যানসার হয়, তার নিখুঁত কার্যকারণ বলা মুশকিল। হাড়ে কোনো সংক্রমণ, প্রদাহ, হাড়ের অতিরিক্ত বৃদ্ধি, জেনেটিক ফ্যাক্টর; এমন বিভিন্ন কারণেই হতে পারে হাড়ের ক্যানসার।

হাড় ক্যানসারের লক্ষণ

  • কোথাও আঘাত পাননি, কিন্তু হাড়ে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। এই ব্যথা হয়তো একটানা নয়। কিন্তু হঠাৎ করেই ব্যথা শুরু হচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। অনেক সময় ভারী কিছু ওঠানামা করা, কিংবা সিঁড়ি ভাঙ্গা; এরকম কারণে তীব্র ব্যথা হয়।
  • হাড়ের ব্যথার স্থানে ফুলে যাচ্ছে। গোঁটার মতো বোধ হয়। অনেক সময় জয়েন্ট ফুলে যায়।
  • হাড়ের ক্যান্সার হলে ধীরে ধীরে হাড়ের ক্ষয় হতে শুরু হয়, ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায়। ওঠা-বসা, বিছানায় সহজভাবে গড়াগড়ি দেওয়া, হাঁটু গেঁড়ে বসা, উবু হওয়া; প্রভৃতি শারীরিক নড়াচড়ায় অসুবিধা হয়।
  • অঙ্গবিকৃতি হয়ে যাওয়া।
  • পা অচেতন তথা বোধহীন হয়ে যাওয়া।
  • প্রচন্ড শারীরিক দুর্বলতা।
  • ওজন কমে যাওয়া।
  • রক্তশূন্যতা, ঘন ঘন জ্বরে ভোগা।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

  • কিছু শারীরিক পরীক্ষা এবং বিস্তারিতভাবে পরিবার এবং ব্যক্তিগত ইতিহাস জানার পরে, ডাক্তার নিম্নলিখিতভাবে পরীক্ষাগুলি এক বা একাধিক করতে পারেন।
  • অ্যালক্যালাইন ফসফটের মতো হাড়ের মাধ্যমে তৈরি এনজাইমের অস্বাভাবিক মাত্রা শনাক্ত করার জন্য রক্তপরীক্ষা। তবে এই পরীক্ষা ক্যানসারের উপস্থিতি নিশ্চিত করে বলতে পারে না।
  • ক্যানসারের অবস্থান এবং আকার সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে এক্স-রে, বোন স্ক্যান, এমআরআই এবং সিটি স্ক্যানের মতো এক বা একাধিক পরীক্ষা করা হয়।
  • বায়োপসি, যেখানে আক্রান্ত হাড় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ক্যানসারের কোষগুলির পরীক্ষা করা হয়।
  • শরীরের অন্যান্য কোষে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে কিনা দেখার জন্য পিইটি সিটি স্ক্যান করা হয়।

হাড়ের ক্যানসারের একটি সাধারণ চিকিৎসা হলো সার্জারি। অন্যান্য বিকল্প চিকিৎসার মধ্যে অন্যতম হলো রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। এটি অবশ্য রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে।

হাড়ের সুস্থতায় করণীয়

পর্যাপ্ত শাক-সবজি: সুস্থ হাড়ের ক্ষেত্রে হাড়ের খনিজ ঘনত্ব একটি প্রধান উপাদান। প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি খেলে এই খনিজ ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল প্রভৃতি হাড়ের জন্য উপকারী। শৈশবকালে এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলে যৌবন বা বৃদ্ধ বয়সে হাড়ের সুস্থতা বজায় থাকে।

শরীরচর্চা: নিয়মিত ব্যায়াম করলে হাড়ের খনিজ ঘনত্ব, শক্তি, আকৃতি এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুকে ব্যায়াম বা শরীরচর্চায় আগ্রহী করে তোলা জরুরি।

ছোটবেলা থেকেই শিশুকে ব্যায়াম বা শরীরচর্চায় আগ্রহী করে তোলা জরুরি।

প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার: সুস্থ হাড় গঠনে প্রোটিন অপরিহার্য উপাদান। ডিম, দুধ, কুমড়োর বীজ, মাছ, চিনাবাদাম প্রভৃতিতে প্রচুর প্রোটিন রয়েছে।

উচ্চ ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার: ক্যালসিয়াম হচ্ছে হাড়ের প্রধান খনিজ উপাদান। তাই দিনে একাধিকবার উচ্চ ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ সুস্থ হাড় গঠনে খুবই উপকারী। পনির, দই, কাজুবাদাম, ডাল, ডুমুর, দুধ প্রভৃতি ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবারের ভালো উৎস।

ভিটামিন ডি ও ভিটামিন কে: ভিটামিন ডি ও ভিটামিন কে হাড়ের স্বাস্থ ভালো রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। মাশরুম, টোনা মাছ, পাঙ্গাস মাছ প্রভৃতি খাবারে ভিটামিন ডি এবং শালগম, বেদানার রস, পালংশাক, ব্রোকলি, গাঁজরের রস প্রভৃতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন কে রয়েছে।

ক্যালরিযুক্ত খাবার পরিহার: চিনিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত তেল, ঘি, মাখনযুক্ত খাবার প্রভৃতি ক্যালরিযুক্ত খাবার পরিহার করা শক্তিশালী হাড় গঠনের জন্য সহায়ক।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp