পায়ে ব্যথা-ইউরিক অ্যাসিডজনিত সমস্যা নয় তো!
-অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান
রফিক হোসেন। বয়স পঞ্চান্ন বছর। রাতে পায়ে হালকা ব্যথা নিয়ে ঘুমোতে যান তিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে পা ফেলে হাঁটতে পারছেন না। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ফুলে লাল হয়ে গেছে। পা-সহ সারা গায়ে তীব্র ব্যথা। হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না। জুতো পরতেও ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। সাধারণত গাউট বা গেঁটে বাতের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা দেখা যায়।
শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে বলা হয় হাইপারইউরিসেমিয়া। এই অ্যাসিড বাড়লে সাধারণত তেমন উপসর্গ দেখা দেয় না। চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না। তবে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিডের কারণে গেঁটে বাত, কিডনিতে পাথর ও অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড আমাদের অস্থিসন্ধিতে জমা হয়। অতিরিক্ত বাড়লে সেখান থেকে শুরু হতে পারে প্রদাহ। তখন পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির সন্ধি লাল হয়ে ফুলে যায় এবং তীব্র ব্যথা শুরু হয়। সেই সঙ্গে পায়ের অন্যান্য অংশেও বেশ ব্যথা অনুভূত হতে পারে। অনেকসময় শরীরের অন্যান্য অস্থিসন্ধিও আক্রান্ত হতে পারে।
যেসব কারণে বাড়ে ইউরিক অ্যাসিড
মানুষের শরীরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে ইউরিক অ্যাসিড থাকে। আমিষজাতীয় খাবার ও কোষের বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে এটি তৈরি হয়। অসচেতনতাবশত আমরা প্রায়ই এমন খাবার খাই যা আমাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। অতিরিক্ত ওজন বাড়লে এবং আমিষজাতীয় খাবার বেশি খেলে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে।
কিডনি থেকে প্রস্রাবের মাধ্যমে ইউরিক অ্যাসিড শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। শরীরে এই অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে গেলে এবং এটি বের হতে না পারলে পায়ের হাড়ের সন্ধিতে জমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সন্ধি ফুলে প্রদাহ দেখা দেয়। সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি ও এর জটিলতা দেখা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও এটি হতে পারে। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, কিডনির জটিলতা থাকলে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যেতে পারে।
সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছর
বয়সীদের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড
বৃদ্ধি ও এর জটিলতা বেশি হতে দেখা যায়।
যেসব সমস্যা হতে পারে
দীর্ঘদিন ধরে রক্তে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড দ্রবীভূত থাকলে অস্থিসন্ধির মধ্যে ক্রিস্টাল বা স্ফটিক হিসেবে জমা হয়। দেখা দেয় পায়ের ও শরীরের অন্যান্য সন্ধিতে ব্যথা এবং প্রদাহসহ নানা ধরনের জটিলতা। ইউরিক অ্যাসিড আমাদের খাবার হজমের সময় শরীরে উৎপন্ন হয়। এই অ্যাসিডে পিউরিন নামের একধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে, যা বেশ কিছু খাবারের মধ্যেও পাওয়া যায়। এটি কিডনির মাধ্যমে ছেঁকে বেরিয়ে যায়। কিডনি যখন সঠিকভাবে ছাঁকতে পারে না তখন এটি রক্তে মিশে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পরবর্তীকালে কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
উপসর্গ
পায়ের সন্ধিতে ইউরিক অ্যাসিড জমে তীব্র ব্যথা হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির সন্ধি লাল হয়ে ফুলে যায় এবং তীব্র ব্যথা হতে থাকে। শেষ রাতের দিকে ব্যথা শুরু হয়ে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। হাঁটাচলা এমনকি পায়ের নাড়াচাড়াতেও অসুবিধা হতে পারে।
এসব সমস্যা সাধারণত সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে কমে যায়। ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে যেসব উপসর্গ দেখা যায়—
- পায়ের সন্ধি, গোড়ালি ও হাঁটুতে তীব্র ব্যথা
- পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির সন্ধি ফুলে যাওয়া ও ব্যথা
- সারা শরীরে ব্যথা
- পিঠ বা কোমরে ব্যথা
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
বর্তমানে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন অনেকটাই দায়ী। যাদের কিডনির সমস্যা বা অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত কোনো সমস্যা নেই তাদের ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে ব্যথা ও অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।
বেশিরভাগ মানুষ শরীরে ইউরিক অ্যাসিড নিয়ে সচেতন থাকেন না। ইউরিক অ্যাসিড কমানোর চিকিৎসায় সবসময় ওষুধের প্রয়োজন নেই। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে এই সমস্যা এড়িয়ে চলা সম্ভব।এজন্য নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো মেনে চলুন—
- ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- প্রচুর পানি পান করুন।
- পিউরিনযুক্ত খাবার যেমন- লাল মাংস, কলিজা, সামুদ্রিক মাছ, অ্যালকোহল ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
- অতিরিক্ত চিনি, মসুর ডাল, শিমের বিচি, পালং শাক খেলে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যেতে পারে।
- বেশি বেশি সাইট্রাসযুক্ত ফল যেমন-লেবু, কমলা, আঙুর প্রভৃতি খেতে পারেন।
- অধিক তেল-মশলাযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- শরীরকে সক্রিয় রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করবেন না।
অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান
এমবিবিএস, এফসিপিএস (ফিজিক্যাল মেডিসিন)
ফেলো-ডব্লিউএইচও (পাকিস্তান)
এমআইএসপিআরএম (সুইজারল্যান্ড)
বাত, ব্যথা, প্যারালাইসিস ও আর্থ্রাইটিস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা।
চেম্বার: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।