পেপটিক আলসার ও ডিসপেপসিয়া

অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিক অতি পরিচিত এক সমস্যা। কখনো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় আক্রান্ত হননি আশপাশে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া হয়তো কঠিন। তবে, বাঙালির ঘরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ পাওয়া কঠিন নয়। পেট ফাঁপা, ফুলে যাওয়া, গুড়গুড়, বমিভাব এসব সমস্যা হলে অনেকেই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খান। এতে সাময়িকভাবে কিছুটা আরাম মেলে। তবে সমস্যা পুরোপুরি সেরে যায় না। বদহজম ও পেটের এসব সমস্যাকে একসঙ্গে পেপটিক আলসার ও ডিসপেপসিয়া বলা হয়।

ডিসপেপসিয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। অর্গানিক ও ফাংশনাল। ফাংশনাল ডিসপেপসিয়ার পেছনে সাধারণত জটিল কোনো কারণ নেই। এটি খাদ্যাভ্যাসের অনিয়মের কারণে হয়ে থাকে। তবে, অর্গানিক ডিসপেসিয়া—পেপটিক আলসার, গ্যাস্ট্রিক, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স ও অন্যান্য কারণে হয়ে থাকে। পাকস্থলি বা ক্ষুদ্রান্তের প্রথম অংশে ঘা হলে সেটি গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পেপটিক আলসার নামে পরিচিত। দেহের পরিপাকতন্ত্রের যেকোনো অংশেই এটি হতে পারে।

পেপটিক আলসারের ও ডিসপেপসিয়র কারন

সাধারণত দুটি কারণে পেপটিক আলসার হতে পারে—

১. হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি নামক একধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।
২. এনএসএআইডিএস-জাতীয় ব্যথার ওষুধ সেবন।

এছাড়া নিম্নোক্ত কারণে পেপটিক আলসার হতে পারে।

  • নিদ্রাহীনতা
  • বংশগত কারণ
  • ধূমপান ও মদ্যপান
  • দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ
  • দ্রুত খাবার গ্রহণ
  • অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ
  • ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স
  • তেল-চর্বিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার বেশি খাওয়া
  • পরিপাকতন্ত্রের ভেতরে ব্লক বা নালি সরু হয়ে যাওয়া
  • জন্মগতভাবে পরিপাকতন্ত্রের গঠনগত কাঠামো দুর্বল হওয়া

পেপটিক আলসার কখনো কখনো উপসর্গ প্রকাশ না করেই
দিনের পর দিন শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।

পেপটিক আলসারের ও ডিসপেপসিয়র উপসর্গ

সাধারণত পেটের ওপরের অংশে সারাদিনজুড়ে মৃদু ব্যথা, থেকে থেকে তীব্র ব্যথা, বমি, বদহজম, খাবার খাওয়ার পরেই ব্যথা-এমন উপসর্গ দেখা দিলে সেটিকেই গ্যাস্ট্রিক বা আলসারের সমস্যা বলে মনে করা হয়। পেট খালি থাকলে বা ক্ষুধার্ত হলে ব্যথা বাড়ে। পেপটিক আলসারের ক্ষেত্রে ব্যথা সবসময় থাকে না। হঠাৎ শুরু হয়ে কয়েকদিন এমনকি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে অন্যান্য যেসব লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে—

  • ক্ষুধামান্দ্য
  • বুকে ব্যথা ও জ্বালা করা
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি
  • পেট ফুলে থাকা
  • অতিরিক্ত ঢেঁকুর
  • খাবার গিলতে সমস্যা
  • বমিভাব বা বমি
  • দ্রুত ওজন হ্রাস
  • মলের সঙ্গে রক্তপাত হওয়া
  • মলের রং খয়েরি বা কালো হওয়া

পেপটিক আলসারের ও ডিসপেপসিয়র পরীক্ষা-নিরীক্ষা

পেপটিক আলসার ও ডিসপেপসিয়া

রোগীর ইতিহাস ও উপসর্গ দেখে রোগ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। তবে, উপযুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া উচিত। পেপটিক আলসার কখনো কখনো উপসর্গ প্রকাশ না করেই দিনের পর দিন শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। এটি নির্ণয়ে ইউরিয়া ব্রেদ পরীক্ষা, রক্তের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা (অ্যান্টি–এইচ পাইলোরি আই জি-জি), স্টুল অ্যান্টিজেন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। কখনো কখনো এটি শনাক্ত করতে এন্ডোস্কপি পরীক্ষাও করা হয়ে থাকে। এন্ডোস্কপির মাধ্যমে কোথায়, কোন অংশে, কতটুকু জায়গাজুড়ে আলসার হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়।

পেপটিক আলসার ও ডিসপেপসিয়ার চিকিৎসা

পেপটিক আলসারের চিকিৎসায় প্রথমেই রোগের কারণ জানা জরুরি। হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এটি হয়ে থাকলে সারা বছর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়েও কোনো লাভ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধের নির্দিষ্ট মেয়াদের কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।

পেপটিক আলসারের চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার জরুরি নয়। তবে সময়মতো চিকিৎসা না করা হলে অ্যাট্রোপিক গ্যাস্ট্রাইটিস, মাল্ট লিম্ফোমা ও গ্যাস্ট্রিক ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারেরও প্রয়োজন হতে পারে।

যদি হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার কারণে না হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের অ্যাসিড নিঃসরণ রোধকারী ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। কারণ যেটিই হোক দ্রুত চিকিৎসা না করলে পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে। রোগীর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এমনকি অন্ত্র ছিদ্র পর্যন্ত হতে পারে।

প্রতিরোধ করবেন যেভাবে

পেপটিক আলসার প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি যা জরুরি তা হচ্ছে—স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। অনেকেই আছেন সকালের নাস্তা বাদ দেন। ভাজাপোড়া খাবার বেশি খান। অনিয়ন্ত্রিত ধূমপান ও মদ্যপান করেন। এসব বদঅভ্যাসগুলো ত্যাগ করে স্বাস্থ্যকর ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে রোগবালাই দূরে সরিয়ে রাখা যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবনের পাশাপাশি আরো যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলা জরুরি—

  • দীর্ঘসময় খালি পেটে থাকবেন না। একসঙ্গে বেশি খাবার খাবেন না।
  • তেল-চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
  • রাতের খাবার আটটার মধ্যেই খেয়ে নিন। খাওয়ার পরপরই বিছানায় শুয়ে পড়বেন না।
  • ধূমপান, মদ্যপান এমনকি কোমল পানীয়ের অভ্যাস ত্যাগ করুন।
  • প্রতিদিন কিছু তাজা ফল খান।
  • শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার খান।
  • পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • যখন-তখন ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করবেন না।
  • নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। সেক্ষেত্রে দৌড়ানো, হাঁটা, সাইকেল চালনা বা সাঁতার বেছে নিতে পারেন।
  • মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকুন। সবসময় প্রফুল্ল থাকার চেষ্টা করুন।
  • মানসিক সুস্থতায় যোগব্যায়াম বা শিথিলায়ন করতে পারেন। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

অধ্যাপক ডা. মিয়া মাশহুদ আহমদ

এমবিবিএস, এমডি, পিএইচডি, এফআরসিপি (এডিন)
অধ্যাপক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ
মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল
প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

LinkedIn
Share
WhatsApp