প্যালিয়েটিভ কেয়ার: ভালোবাসায় রোগীর পাশে

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য
একটু সহানুভ‚তি কি মানুষ পেতে পারে না।’

শিল্পী ভূপেন হাজারিকার সহজ-ছোট্ট কথার এই গানটি অনেক বড় অর্থ বহন করে। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে দীর্ঘকালীন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার ফলে, মানুষের অসহনীয় কষ্ট দেখা হয়েছে খুব কাছ থেকে। আমাদের দেশের মানুষ জীবন যাপনে যেমন খাপছাড়া, তেমনি অসচেতনতাও রয়েছে সর্বত্র। ঢালাওভাবে না হলেও, কথাটি বহুলাংশেই সত্য। ফলে মানুষের রোগগুলো শনাক্ত হয় একেবারে শেষ পর্যায়ে; যখন হয়তো ‘চিরবিদায়ের ডাক’ নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ে। পুরো পরিবার হয়তো জমানো সমস্ত অর্থবিত্ত দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করান। দীর্ঘ সময় চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবার যেমন অর্থকষ্টে পড়ে, পাশাপাশি রোগী নিয়ে বাসা-হাসপাতাল-পরীক্ষাগার দৌড়াদৌড়ি করতে করতে ক্লান্তও হয়ে পড়ে। নির্মম রোগের যন্ত্রণা এবং সেই সঙ্গে পরিবারের কষ্ট দেখে রোগী নিজেকে দায়ী ভাবেন এবং এক ধরনের অপরাধবোধে আক্রান্ত হন। মানসিক হীনম্মন্যতা ও অসংলগ্নতায় ভোগেন। অথচ এই পুরো ব্যাপারটিতে সরাসরি দায় দেওয়া যায় না কাউকেই। এই যে একটি অমীমাংসিত পরিস্থিতি, এমন পরিস্থিতিতে সুন্দর এবং মানবিক সমাধান হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উদ্ভ‚ত হয়েছে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ ধারণাটির।

প্যালিয়েটিভ কেয়ার কী

ইংরেজি ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ প্রশমন সেবা, উপশম। এটি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা। নিরাময়-অযোগ্য রোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা লাঘব করে রাখার ব্যবস্থাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার। এটি একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এর মাধ্যমে রোগীর অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে বেদনাহীন, মর্যাদাপূর্ণ করার পাশাপাশি রোগীর পরিবারকে এই সংকট মোকাবেলায় সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া হয়। এই সহায়তা দেওয়া হয় মানসিক, শারীরিক, সামাজিক এবং আত্মিক; তথা সামগ্রিকভাবে।

প্যালিয়েটিভ কেয়ারের উদ্দেশ্য

  • রোগের যন্ত্রণা ও অন্যান্য শারীরিক বেদনা থেকে মুক্তি দেওয়া।
  • জীবন যাপনের মান উন্নয়ন করা।
  • মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সেবা প্রদান করা।
  • রোগকালীন সংকটে রোগীর পরিবারকে সহায়তা দেওয়া এবং রোগীর মৃত্যু-পরবর্তী কালে রোগীর পরিবারের পাশে থাকা।

প্যালিয়েটিভ মেডিসিন: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

প্যালিয়েটিভ পরিচর্যায় প্যালিয়েটিভ মেডিসিন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। প্যালিয়েটিভ মেডিসিন হিসেবে সাধারণত আফিমজাতীয় ব্যথানাশক ব্যবহার করা হয়।


কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনা যেমন গড়ে ওঠেনি তেমনি সঠিক ও পর্যাপ্ত ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবহারও নেই।

এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে নিম্নলিখিত কারণগুলো উল্লেখ করা যায়-

  • আফিমজাতীয় ব্যথানাশকের প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা।
  • চিকিৎসকদের ভ্রান্ত ধারণা এবং যথাযথ জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব।
  • আফিমজাতীয় ওষুধ গ্রহণে ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক সংস্কার।

প্যালিয়েটিভ কেয়ার এবং কতিপয় রোগ

ইতোমধ্যে আমরা উল্লেখ করেছি, নিরাময় অযোগ্য রোগগুলোর ক্ষেত্রে প্যালিয়েটিভ সেবা আবশ্যক। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে নিম্নলিখিত রোগসমূহের নাম উল্লেখ করা যায়।

  • ক্রনিক কিডনি ডিজিজ/ ডায়ালাইসিসের রোগী
  • বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার
  • আলঝেইমার্স পারকিনসন্স
  • এইডস
  • লিউকোমিয়া এবং লিম্ফোমা
  • হার্ট ফেইলিওর
  • বোন মারো ট্রান্সপ্লান্ট
  • স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া)
  • স্ট্রোক
  • এনিমিয়া- প্রভৃতি।

প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিশ্চিতকরণে জরুরি বিবেচ্য:

  • জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে অন্তর্ভুক্তিকরণ।
  • রাস্ট্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থা ও বাৎসরিক বাজেটে প্যালিয়েটিভ কেয়ার যুক্ত করা।
  • স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ।
  • প্রশিক্ষিত-দক্ষ প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ।

  • যেসব রোগী হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না তাদের জন্য বাড়িতে এ পরিচর্যা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থায় হোম কেয়ার সেবা।
  • দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী।
  • রোগীর প্রতি পরিবারের মানুষদের আন্তরিকতা। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা।
  • তরুণদের সচেতন করে তোলা।

প্যালিয়েটিভ কেয়ার এবং কতিপয় রোগ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এখনো বহুলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিদারুণ কষ্ট পেয়ে পরিবারের কারো মৃত্যু দেখে অন্যান্য সদস্যরাও মানসিকভাবে তীব্র আঘাতপ্রাপ্ত হন। এমতবস্থায়, রোগাক্রান্ত সদস্যের প্রতি পরিবারের অন্যদের আচরণ, আন্তরিকতা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

  • বাবা, মা বা অন্য কেউ এমন রোগাক্রান্ত অবস্থায় থাকলে তার মাথার পাশে বসুন। মাথায় হাত রেখে আন্তরিকতা নিয়ে বলুন, ‘ভয় কী! আমরা সবাই পাশে আছি’।
  • গৃহকর্মী বা বেতনভুক্ত সেবক-সেবিকা দিয়ে নয়, বয়স্কদের সেবা করুন নিজ হাতে।
  • রোগীকে কখনো একা রাখবেন না।
  • বাধ্য হয়ে সেবক-সেবিকার সার্বক্ষণিক পরিচর্যায় রাখলেও দিন শেষে অন্তত একবার কিংবা যখনই সময় পাবেন, রোগীর পাশে বসে সময় দিন।
প্রশমন-সেবা কেবল মৃত্যুপূর্ববর্তী সময়ের জন্য নয়। বরং এই সেবা দেওয়া উচিত যেকোনো নিরাময়-অযোগ্য রোগ শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গেই। প্রতিটি শিশুর জন্ম যেমন নিরাপদ, তেমনি প্রতিটি মৃত্যুও হওয়া উচিত নিরাপদ মৃত্যু এবং তা সম্ভব শুধুমাত্র মূল চিকিৎসার সঙ্গে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের সমন্বয়ের মাধ্যমে।

ডা. লতিফা সুলতানা
এমবিবিএস, এমএসসি, ক্যানসার থেরাপিউটিকস (যুক্তরাজ্য), এনএফপিএম (ভারত) বিশেষজ্ঞ (অনকো প্যালিয়েটিভ)
স্কয়ার অনকোলজি অ্যান্ড রেডিওথেরাপি সেন্টার
স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp