প্রসূতি মায়ের পরিচর্যা
-অধ্যাপক ডা. আফজালুন্নেছা চৌধুরী
নারীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় মাতৃত্ব। একটি ভ্রূণকে গর্ভসঞ্চারের মুহূর্ত থেকে মানবশিশু রূপে পৃথিবীর আলোয় নিয়ে আসা পর্যন্ত একজন প্রসূতিকে যেতে হয় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এ সময় প্রসূতির বিশেষ যত্নের বিকল্প নেই। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর পরবর্তী ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত মায়ের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক কম থাকে। ফলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়। সুস্থ-স্বাভাবিক সন্তান জন্মের প্রথম শর্ত গর্ভবতী মায়ের সঠিক পরিচর্যা।
পরিকল্পিত গর্ভধারণ
পরিকল্পিত গর্ভধারণ মা ও শিশু দুজনের জন্যই নিরাপদ। একজন নারী গর্ভধারণের পর তার প্রতি পরিবারের দায়িত্ব বেড়ে যায় কয়েক গুণ। গর্ভবতী মায়ের পাশাপাশি সন্তানের বাবা ও পরিবারের সকল সদস্যকে নিরাপদ মাতৃত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সন্তান ধারণের আগে মায়ের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ বা থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি এড়াতে সন্তান ধারণের অন্তত তিন মাস আগে থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিডসহ অন্যান্য ওষুধ খেতে হবে। এ ছাড়া প্রসূতি মায়ের খাবার হতে হবে সুষম।
প্রসূতি মায়ের খাবার
গর্ভাবস্থায় শিশুর শরীরে লৌহের চাহিদা মেটানোর পর বেশির ভাগ মায়েদের হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দেয়। এ সময় মায়েদের লৌহসমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। পাশাপাশি ক্যালরি বাড়াতে খেতে হবে পর্যাপ্ত আমিষ। আমিষজাতীয় খাবারের মাধ্যমেই ভ্রূণের বিকাশ ঘটতে থাকে। গর্ভাবস্থায় মায়ের জনন অঙ্গের বৃদ্ধি, বিকাশ ও ভ্রূণের বিপাক হার মায়ের সাথে যুক্ত হওয়ায় মৌল বিপাক হার বেড়ে যায়। গর্ভধারণের ৩ মাস পর থেকে অতিরিক্ত ৩০০ কিলোক্যালরি গ্রহণ জরুরি। এ ছাড়াও ভ্রূণের বৃদ্ধি, হাড় গঠন ও দৃঢ়তার জন্য ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ও আয়োডিন দরকার হয়। প্রতিদিন খাবারে ছোটোমাছ, দুধ, ডিম ও সবুজ শাকসবজি রাখতে হবে।
প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার ২০০ নারীর মৃত্যু হয় গর্ভকালীন,
প্রসবকালীন এবং সন্তান জন্মের পর সৃষ্ট জটিলতায়।
প্রসূতির পোশাক ও পরিচ্ছন্নতা
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শারীরিক পরিবর্তন খুব দ্রুত হতে থাকে। ওজন বেড়ে যায়। এ সময় সুতির ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পরতে পারেন। ঘরে ও বাইরে পরার কাপড় সব সময় পরিষ্কার রাখুন। নিয়মিত গোসল করে দ্রুত চুল শুকিয়ে নিতে হবে। দুই বেলা নিয়ম করে দাঁত ব্রাশ করা জরুরি। হাত ও পায়ের নখ পরিষ্কার রাখুন। হিল জুতার পরিবর্তে বেছে নিতে হবে আরামদায়ক ফ্ল্যাট জুতা বা স্যান্ডেল।
কোষ্ঠ পরিষ্কার
প্রতিদিন মলত্যাগের অভ্যাস করা জরুরি। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে ফল, শাকসবজি, বেলের শরবত, ইসবগুলের ভুসি ও প্রচুর পানি পানের মাধ্যমে সহজে কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখা যেতে পারে।
টিকা প্রদান
গর্ভসঞ্চারের আগে যদি কোনো নারীর পাঁচবার টিটেনাস টিকা দেওয়া থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় তার টিকার প্রয়োজন নেই। যদি দেওয়া না থাকে, তাহলে গর্ভকালীন পাঁচ-ছয় মাসে একটি টিটি টিকা ও এক মাস পর আরেকটি টিটি টিকা দিতে হবে।
ব্যায়াম ও বিশ্রাম
প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করার পাশাপাশি সকালে ও সন্ধ্যায় হাঁটাহাঁটি করা দারুণ কার্যকর। হালকা শরীরচর্চা করা যেতে পারে। তবে ভারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। একজন প্রসূতির প্রতিদিন আট ঘণ্টা ঘুম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন।
প্রসবের পর প্রসূতির পরিচর্যা
- ভিটামিন ডি’র চাহিদা পূরণে মা ও শিশু দুজনেই প্রতিদিন কিছুক্ষণ সূর্যের আলোতে থাকবেন।
- প্রতিবার শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর আগে মাকে এক গ্লাস
- দুধ বা ফলের রস খাওয়ান।
- ফাস্ট ফুড, মিষ্টি, তেল-চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে প্রতিদিন গাঢ় সবুজ ও রঙিন শাকসবজি খেতে হবে।
- শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস মায়ের দুধ খাওয়ান, এতে মায়ের শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমে যাবে।
- শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ অব্যাহত রাখতে প্রসূতির আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া দরকার।
- চা-কফি পান করার অভ্যাস থাকলে কমাতে হবে।
- বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের সাপ্লিমেন্ট বা ওষুধ সেবন করবেন না।
শিশুর জন্মের পর মায়ের দেহের গর্ভধারণজনিত ঘাটতি পূরণে প্রায় দুই বছর সময় লাগে। কারও কারও স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়। মুটিয়ে যান অনেকেই। শারীরিক এসব পরিবর্তনে অনেক নারীই হতাশায় ভোগেন। প্রসবের পর মায়ের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
অধ্যাপক ডা. আফজালুন্নেছা চৌধুরী
এমবিবিএস, ডিজিও, এমসিপিএস, এফসিপিএস (অবস ও গাইনি)
ট্রেইন্ড ইন অ্যাডভান্সড কলপোস্কপি অ্যান্ড ল্যাপারোস্কপি
প্রাক্তন অধ্যাপক
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল