অধ্যাপক মেজর (অব:) ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু
১. কয়েকদিন আগে প্রথম আলো পত্রিকার একটি শিরোনামে চোখ আটকে গেল। মেয়ের নাম ‘স্পৃহা’ রেখে আইসিইউ থেকে মায়ের চিরবিদায়। বিয়ের নয় বছর পর কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে সন্তানকে একবারের জন্য কোলেও নিতে পারেননি লাবনী রায়। সন্তান এবং মায়ের মাঝখানে যেন দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল করোনাভাইরাস। আইসিইউতে মেয়ের নাম রাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
২. পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকে দীর্ঘ সাত বছর প্রেমের পর বছর দেড়েক আগে ঘর বাঁধেন শিমু ও মুহিব (ছদ্মনাম) দম্পতি। গত কয়েকদিন আগে সন্তান জন্ম দেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় মারা যান শিমু। ওদের এত বছরের প্রেম, চাকরি বাকরি, বিয়ে, বাবা-মা হওয়া, একসঙ্গে সুখী হওয়ার স্বপ্ন; সবই যেন এক নিমিষে গ্রাস করে নিল কোভিড-১৯ নামের ছোট্ট একটা ভাইরাস।
৩. নয় মাসের অন্ত:সত্ত্বা ছিলেন ডা. জারিন তাসনীম রিমি। তিন দিন জ্বর থাকায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরদিন সকালে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। দুপুরে মারা যান তিনি।
পরিসংখ্যান বলে, করোনা অতিমারির আগে দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের আওতায় ছিল। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিত। কিন্তু করোনার প্রভাবে তা কমে এসেছে অনেকটাই। ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’(এমআইএস) এর তথ্যমতে, এই হার বর্তমানে ৪১ শতাংশ। করোনার কারণে চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে প্রসূতি মা ও নবজাতক শিশুর চিকিৎসা গ্রহণের হার যেমন কমেছে তেমনই এই সময়ে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ইপিআই এর তথ্যানুযায়ী, মহামারির আগে ৫০ শতাংশ প্রসব হতো বাড়িতে। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৩ শতাংশ। ২০১৯ সালের মার্চে প্রসবপূর্ব সেবা পাওয়া গর্ভবতী ছিলেন ৪২ হাজার ৫২৬ জন। ২০২০ সালের মার্চে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ৩৬ হাজার ৪১৫। পরিস্থিতির আরো অবনতি হয় এ বছর এপ্রিলে। মহামারির আগে, অর্থাৎ ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রসবপূর্ব সেবা পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৫৭১ জন গর্ভবতী। গত বছর এ সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৬২ জনে। আর করোনার কারণে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা গ্রহণ করেননি ১১ শতাংশ নারী।
গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতির সম্ভাবনা
গর্ভাবস্থায় এমনিতেই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। তাই গর্ভাবস্থায় যেকোনো ফ্লু বা অন্য কোনো সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি থাকে। আবার বুক ও পেটের মধ্যের ডায়াফ্রাম নামক পর্দাটি এ সময় একটু উপরের দিকে উঠে যায় বলে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ নারীদেরও শেষের দিকে শ্বাসকষ্ট হয়। এছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য গর্ভপাত, শিশুর বৃদ্ধি ব্যহত, অপরিণত অবস্থায় শিশুর জন্ম, জন্মগত ত্রæটি, শিশুমৃত্যু এমনকি মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যু হতে পারে। গর্ভবতী কোনো নারী করোনা আক্রান্ত হলে সাধারণ মানুষের তুলনায় তার মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। তাই এ সময় যেকোনো ধরনের কাশি-জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
নবজাতকের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কতটুকু
করোনা আক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুর আক্রান্ত হওয়ার কোনো তথ্য এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে জন্মের পর সংক্রমিত হতে পারে। তাই মা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে জন্মের পর শিশুকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখাই উত্তম।
শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান নিরাপদ কি না
এখনো মায়ের বুকের দুধে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। করোনা আক্রান্ত মায়ের দুধ পানে শিশুর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুব একটা নেই বললেই চলে। করোনা আক্রান্ত মা নিশ্চিন্তে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। কিন্তু আক্রান্ত মায়ের থেকে যেহেতু শিশু আক্রান্ত হতে পারে তাই শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় মাকে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। হাত ও স্তন ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
এ সময়ে করণীয়
করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে সাবধানতা অবলম্বনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পরিচ্ছন্নতাবোধ বা হাইজিন সেন্সের বিকল্প নেই। যেহেতু গর্ভাবস্থায় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায় তাই এ সময়ে গর্ভবতী নারীদের আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। মার্কেট, মেলা, বিয়েবাড়ি ও গণপরিবহন যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। এ সময়ে বাড়িতে অতিথি আগমন কিংবা অনুষ্ঠানাদি করা থেকে বিরত থাকুন। খুব প্রয়োজন না হলে ভ্রমণ করবেন না। বাইরে বের হলে অবশ্যই সঠিক নিয়মে উন্নতমানের মাস্ক ব্যবহার করুন। অসুস্থ ব্যক্তির কাছে যাবেন না। বারবার হাত পরিষ্কার করুন। পশুপাখি বা কাঁচা মাছ, মাংস ছোঁবেন না বা ছুঁলেও দ্রুত সাবানপানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। নাকে, মুখে, চোখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। যেকোনো ধরনের কাশি বা জ্বর হলে শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অধ্যাপক মেজর (অব:) ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু
এমবিবিএস (ঢাকা), ডিজিও (ডিইউ), এফসিপিএস
(অবস্ ও গাইনি), এফআইসিএস
চিফ কনসালট্যান্ট, অবস্ এন্ড গাইনি
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা