প্রস্রাবের সময় ব্যথা কিডনির সমস্যা নয় তো!
-ডা. এ.এস.এম জুলফিকার হেলাল
শারমিন নাহার একজন স্কুলশিক্ষিকা। বয়স পঁয়ত্রিশ। কয়েক সপ্তাহ ধরে মাঝে মাঝে পা ফুলে যায়। নিয়মিত জ্বর-কাশি লেগেই আছে। প্রায় রাতেই প্রস্রাবের বেগে ঘুম ভেঙে যায়। হয়তো অতিরিক্ত পানি পান করছেন ভেবে শুরুতে তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে হাসপাতালে যান। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি রক্তের কিছু পরীক্ষা করতে বললেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, তার দুটো কিডনির কোনোটিই পুরোপুরি সুস্থ নেই। তবে বেশি দেরি হয়নি, চিকিৎসার মাধ্যমে এখনো সেরে ওঠা সম্ভব।
শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে কিডনি অন্যতম। বিভিন্ন কারণে কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত জটিল আকার ধারণ না করলে কিডনি রোগের লক্ষণ খুব একটা প্রকাশ পায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ কিডনি রোগীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তারা আগে থেকে কিছুই বুঝতে পারেননি। হঠাৎ করেই কিডনির রোগের কথা জানতে পারেন। কারো কারো ক্ষেত্রে খুব বেশি দেরি হয়ে যায়। কেউ কেউ ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে কোনো রকমে বেঁচে থাকেন।
প্রস্রাবে ব্যথা হলেই কি কিডনি সমস্যা
প্রস্রাবে ব্যথা, প্রস্রাব কম বা বেশি হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হওয়া প্রভৃতি কিডনি রোগের লক্ষণ। তবে কেবল কিডনি সমস্যা হলেই এই উপসর্গগুলো দেখা দেবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ডায়াবেটিস, টিউমার, মূত্রথলির সমস্যা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, পুরুষদের প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড বড়ো হয়ে যাওয়া, মহিলাদের জরায়ুমুখের প্রদাহসহ নানান কারণে কিডনির ছাঁকনিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রস্রাবে ব্যথা ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন চার পাঁচবার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক। নিয়মিত যদি এর চেয়ে বেশি বা কম হতে থাকে তাহলে দ্রুত একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন।
কিডনির সুস্থতায় অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার,
মদ্যপান, ধূমপান এড়িয়ে চলুন।
কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছেন যারা-
- উচ্চরক্তচাপ ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি।
- যারা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড বা ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করছেন।
- আগে প্রস্রাবের সংক্রমণ হয়েছে যাদের।
- পানি কম পান করেন যারা।
- ধূমপান করেন এমন ব্যক্তি।
- অতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটি আছে যাদের।
- যাদের পরিবারের কোনো নিকট আত্মীয় আগে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
- আগে কিডনিতে প্রদাহ হয়েছে এমন ব্যক্তি।
কিডনি রোগের উপসর্গ
- কোনো কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন কমতে থাকা।
- সারাক্ষণ ক্লান্তি ও অবসাদ অনুভব করা।
- মুখ, হাত, পায়ের গোড়ালি, চোখের নিচে স্থায়ী ফোলাভাব।
- ঘুমের অসুবিধা হওয়া।
- ত্বকের রং পরিবর্তন ও চুলকানি হওয়া।
- ঘনঘন প্রস্রাব বা প্রস্রাব কম হওয়া।
- প্রস্রাবের সময় ব্যথা অনুভব করা।
- খাওয়ার অরুচি।
- বমি, বমিভাব।
- কোমরের দুইপাশে ও তলপেটে ব্যথা হতে পারে।
- মাংসপেশিতে টান লাগা ও খিঁচুনি হতে পারে।
- সারাক্ষণ শীত অনুভূত হওয়া।
- শ্বাসকষ্ট।
কিডনির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ যেসব খাবার
অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার, চিনি, তামাক প্রভৃতি কিডনির জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি অতিরিক্ত ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার কিডনির জন্য ক্ষতিকর। আমলকি, কামরাঙ্গা এই ফলগুলো ভিটামিন-সি’তে পরিপূর্ণ। দেহের জন্যও দারুণ উপকারী। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে এসব ফল খেলে ও ফলের রস পান করলে কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি আছে। এছাড়া অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার, ধূমপান, মদ্যপান কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
কিডনির সুস্থতায় যা করবেন
কিডনি সুস্থ রাখতে কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। উপসর্গগুলো খুব সহজে ধরা দেয় না। তাই ছোটো বা সামান্য কিছু চোখে পড়লেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রয়োজনে প্রস্রাবের অ্যালবুমিন বা মাইক্রো অ্যালবুমিন ও রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করাতে হবে। যাদের উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিস আছে তাদের সবসময় তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিডনির জটিলতা এড়ানো যায়।
ডায়রিয়া, বমি ও আমাশয়ের কারণে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় খনিজ বেরিয়ে যায়। এতে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি বিকল হয়ে যেতে পারে। এ সময় প্রচুর পরিমাণে স্যালাইন পান করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে প্রস্রাবে ইনফেকশন, কিডনিতে পাথর ও প্রোস্টেটের সমস্যা থাকলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব রোগ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন করবেন না। প্রচুর পানি পান, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, সচেতনতা ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করার মাধ্যমে কিডনি সুস্থ রাখা সম্ভব।
ডা. এ.এস.এম জুলফিকার হেলাল
এমবিবিএস, এমডি (নেফ্রোলজি)
কিডনি, মেডিসিন ও ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, এএমসিএইচ, ঢাকা
সাবেক সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
টিএমসিএইচ, বগুড়া
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল