বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ

বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ

বর্ষাকাল মানেই যখন-তখন বৃষ্টি। কখনো একটানা ভারী বর্ষণ। কখনো আচমকা বৃষ্টি নেমে চারপাশ থইথই করে দেয় অল্প সময়েই। তখন আমাদের ঘরবাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন আবদ্ধ জায়গা বা ছোটোখাটো গর্তে পানি জমে যায়। শহরের বহুতল ভবনের ব্যালকনিতে, গাছের টবে কিংবা ছাদের কোনায় পানি জমে। এসব পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে তা নানা রকম পানিবাহিত রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ

বিশেষত, জমে থাকা এসব পানিতে মশার লার্ভা জন্ম নেয়। ফলে বেড়ে যায় মশার বিস্তার। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মশাবাহিত রোগ। মশাবাহিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে ডেঙ্গু। এ সময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায় অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায়।

প্রতিবছর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রচুর মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে রোগটির প্রকোপ বৃদ্ধি পায় আশঙ্কাজনকভাবে। বিশেষত বর্ষাকাল ডেঙ্গুর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঋতু। অসচেতনতা এবং আক্রান্ত অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণা না থাকার ফলে ডেঙ্গু অনেকসময় ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

বর্ষাকালে ডেঙ্গু বাড়ে কেন

আমরা জানি, এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। মূলত স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে থাকে। আর এই মশা সাধারণত আবদ্ধ এবং তুলনামূলক পরিষ্কার পানিতে বংশবিস্তার করে। বর্ষাকালের আটকে থাকা পানি মশার বংশবিস্তারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।

ডেঙ্গুর লক্ষণ ও ধরন

সাধারণত এডিস মশা কামড়ানোর তিন থেকে দশ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। প্রধানতম লক্ষণ হচ্ছে উচ্চমাত্রার জ্বর। কখনো কখনো এই মাত্রা ৯৯° ফারেনহাইট থেকে ১০৪° ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে যায়। এ ছাড়া নিম্নোক্ত লক্ষণসমূহ দেখা দেয়—

  • শরীরে প্রবল ক্লান্তি দেখা দেয়। সারাদিন অবসন্ন লাগে।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যার পাশাপাশি বুকে ব্যথা হতে পারে।
  • শরীর বা মাথায় তীব্র ব্যথা হতে পারে।
  • পেটে ব্যথা হতে পারে।
  • অনেকসময় বমিভাব বা অনবরত বমিও হয়ে থাকে।
  • দাঁতের মাড়ি, নাক দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। বমি বা মলের সঙ্গেও রক্ত আসতে পারে।
  • প্রস্রাবে সমস্যা হয়। ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা ধরে প্রস্রাব না হওয়া বা খুবই অল্প পরিমাণে প্রস্রাব হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
  • কোনো নারী পিরিয়ড চলাকালে আক্রান্ত হলে অতিরিক্ত রক্তপাত হয়ে থাকে।
  • ত্বকে লালচে ছোপ, র‌্যাশ বা ফুসকুড়ি উঠে থাকে।
  • খাবারে অরুচি এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

তবে ডেঙ্গুর ধরন অনুযায়ী এসব লক্ষণের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। আমাদের দেশে সাধারণত দুই ধরনের ডেঙ্গু দেখা যায়—ক্ল্যাসিকাল ও হেমোরেজিক।

বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ

ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু : এ ধরনের ডেঙ্গুতে খুব একটা জটিলতা হয় না। মশার কামড়ের তিন থেকে ১৪ দিনের মাথায় তীব্র জ্বর শুরু হয়। তবে দ্রুতই এ জ্বর সেরে যায় এবং রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।


হেমোরেজিক ডেঙ্গু : হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর বা শকজনিত জ্বর ডেঙ্গুর ভয়াবহ পর্যায়। দ্রুত না সারলে পরিস্থিতি খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার দিকে যেতে থাকে। এক্ষেত্রে রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রক্তনালিতে ছিদ্র হয়ে যায়। তখন দ্রুতহারে প্লাটিলেট (রক্ত জমাট বাঁধার কোষ) কমে যেতে থাকে। ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয় এবং অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। এমনকি রোগী মারা যেতে পারেন।

ডেঙ্গুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা

জ্বর হলেই যে তা ডেঙ্গু—বিষয়টি এমন নয়। ডেঙ্গু হয়েছে কি না প্রথমে তা নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য পরীক্ষা করাতে হবে। অনেকে আবার নিজের মতো পরীক্ষা করিয়ে থাকেন। এটি ঠিক নয়। এতে ফলাফল নিয়ে রোগী বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। ব্যাপারটি চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। লক্ষণ- উপসর্গ দেখে চিকিৎসক যদি ডেঙ্গু বলে সন্দেহ করেন তাহলে জ্বর শুরুর প্রথম দিকেই ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। তবে জ্বর যদি চার-পাঁচদিন পেরিয়ে যায় সেক্ষেত্রে ডেঙ্গু আইজিএম অ্যান্টিবডি টেস্ট দেওয়া হয়। অ্যান্টিজেন পরীক্ষার পাশাপাশি শ্বেতরক্তকণিকা, হিমাটোক্রিট, অণুচক্রিকা প্রভৃতি টেস্ট করাও দরকার হয়।

নিতে হবে হাসপাতালে

একটি বিষয় মাথায় রাখবেন—ডেঙ্গু ভাইরাস মোটামুটি শরীরের সব অঙ্গকেই আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে। এতে আক্রান্ত হলে হার্ট, কিডনি, যকৃৎ কিংবা মস্তিষ্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহের কর্মক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। এতে মৃতুহারও বাড়ছে। সুতরাং রক্তের শ্বেতকণিকা পাঁচ হাজারের নিচে এবং প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

ডেঙ্গু এড়াতে সতর্কতা

ডেঙ্গু প্রতিরোধে বৃষ্টির মৌসুমে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। বাড়ি বা কর্মস্থলের আশপাশে মশার উপদ্রব যেন বাড়তে না পারে তার জন্য সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

  • বাড়ির আঙিনা, ছাদ, ব্যালকনিতে সবজি বা গাছ লাগালে সেসব জায়গা পরিচ্ছন্ন রাখুন। কোথাও যেন বৃষ্টি পানি আটকে না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখুন।
  • এডিস মশা সাধারণত সূর্যোদয়ের পরে ও সূর্যাস্তের আগে কামড়ায়। এ সময় বাইরে অবস্থান করলে ফুলহাতা জামা, প্যান্ট পরিধান করুন।
  • ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাবেন। সম্ভব হলে ঘরের জানালায় নেট লাগিয়ে নিতে পারেন।
  • নিয়মিত ভিটামিন সি-জাতীয় খাবার খাবেন। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবারের ব্যাপারে আন্তরিক হোন।
  • ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন। ধূমপান রক্তের উপাদানে তারতম্য তৈরি করে।

অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা

অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা

এমবিবিএস, পিএইচডি (মেডিসিন), এফএসিপি, এফআরসিপি (এডিন)
অনারারি প্রফেসর, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp