বর্ষায় বাড়ে ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রকোপ

বর্ষায় বাড়ে ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রকোপ

লিভার তথা যকৃতের জটিল একটি রোগ ভাইরাল হেপাটাইটিস। রোগটিকে গড়পড়তাভাবে জন্ডিস বলা হলেও সব ক্ষেত্রে কথাটি ঠিক নয়। ভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়া অন্যান্য নানাবিধ কারণে জন্ডিস হতে পারে। কিন্তু ভাইরাল হেপাটাইটিসের মূল কারণ ভাইরাসজনিত। তাই জন্ডিস ও ভাইরাল হেপাটাইটিস—দুটো ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।

জন্ডিসের জন্য দায়ী

মূলত হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোই জন্ডিসের প্রধান কারণ। তবে এছাড়া অন্যান্য কারণও আছে। যেমন—পিত্তনালী, পিত্তথলি বা অগ্ন্যাশয়ে পাথর এবং এর ফলে বিলিরুবিনের সঞ্চালনপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। আবার হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়ার (রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়া) কারণে জন্ডিস হতে পারে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলেও জন্ডিস হয়ে থাকে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেকসময় জন্ডিসের কারণ হয়।

ভাইরাল হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী

এদিকে ভাইরাল হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে কেবল হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোই দায়ী। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই—ইংরেজি বর্ণমালার এই প্রথম পাঁচটি বর্ণের নাম অনুযায়ী ভাইরাসগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। এগুলোর দ্বারা সংক্রমিত হলে লিভারে প্রদাহ তৈরি হয়, যা ভাইরাল হেপাটাইটিস নামে পরিচিত।

বর্ষাকালে ভাইরাল হেপাটাইটিস

বর্ষাকালে খাবার ও পানিবাহিত সব রোগের ঝুঁকিই বেড়ে যায়। হেপাটাইটিস এ ও ই-এর ক্ষেত্রে দূষিত খাবার ও পানিই প্রধান কারণ। এ সময় বৃষ্টির কারণে স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ স্যানিটেশনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রকোপ বেড়ে যায়। আমাদের দেশে ভাইরাস- ঘটিত হেপাটাইটিসই বেশি হয়ে থাকে।
অন্যদিকে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহার, স্যালুনে দাড়ি-গোঁফ কামানো, রক্তদান, যৌনসম্পর্ক ও আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের মাধ্যমে ছড়ায় হেপাটাইটিস বি। তবে অন্যান্য মাধ্যমে ছড়ানো হেপাটাইটিস খুব সহজেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু গর্ভবতী মায়ের মাধ্যমে সন্তান সংক্রমিত হলে অনেক ক্ষেত্রেই তা দীর্ঘমেয়াদি অবস্থায় চলে যায়।

https://shukheoshukhe.com/

হেপাটাইটিস এ ও ই-এর লক্ষণ

এই দুই ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাসে সংক্রমণের লক্ষণ ও উপসর্গ প্রায় একই। হেপাটাইটিস এ সাধারণত শিশু-কিশোরদের আক্রান্ত করে। অন্যদিকে হেপাটাইটিস ই ভাইরাস বয়স্কদের সংক্রমিত করে থাকে। এ কিংবা ই—যেকোনোটিতে সংক্রমিত হলে রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ প্রকাশিত হতে পারে আবার অপ্রকাশিতও থাকতে পারে। অনেকসময় লক্ষণগুলো আবার নির্দিষ্টও থাকে না।

হেপাটাইটিস ‘এ’ শরীরে প্রবেশের ২—৪ সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে। হেপাটাইটিস ‘ই’-এর ক্ষেত্রে এই লক্ষণ প্রকাশের সময়কাল ২—৮ সপ্তাহ। যেকোনো একটি বা একাধিক লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

হেপাটাইটিস এ ও ই-এর তিনটি পর্যায় রয়েছে। পর্যায়গুলোর ওপর নির্ভর করে এর লক্ষণও ভিন্ন হয়ে থাকে।

প্রাথমিক পর্যায়

  • জ্বর
  • অস্থিসন্ধিতে ব্যথা (আর্থ্রাইটিস)
  • ত্বকে র‌্যাশ ওঠা
  • ক্ষুধামান্দ্য
  • মাংসপেশি ফুলে যাওয়া

দ্বিতীয় পর্যায় (জন্ডিসপূর্ব)

  • ক্লান্তি ও অবসাদ
  • মাংসপেশিতে ব্যথা (মায়ালজিয়া)
  • খাবারে অনীহা (অ্যানোরেক্সিয়া)
  • বমিভাব/ বমি
  • জ্বর
  • কাশি
  • পেটে ব্যথা
  • ডায়রিয়া
  • গাঢ় রঙের প্রস্রাব

তৃতীয় পর্যায় (জন্ডিস)

  • ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া ও চোখ সাদা হয়ে যাওয়া
  • অরুচি, বমিভাব ও বমির মাত্রা বেড়ে যাওয়া
  • ত্বকের নানা রকম সমস্যা (চুলকানি, র‌্যাশ ওঠা, ফোস্কা পড়া) বেড়ে যাওয়া
  • ডায়রিয়া তথা পাতলা পায়খানা তীব্র পর্যায়ে
  • চলে যাওয়া

যেসব জটিলতা হতে পারে

সাধারণত সুস্থ-সবল ব্যক্তি আক্রান্ত হলে খুব একটা সমস্যা হয় না। অল্প সময়েই কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেন। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম এবং অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে ভালোই সমস্যা হয়ে থাকে। লিভারে দীর্ঘমেয়াদি কোনো অসুখ বেঁধে যেতে পারে। তা ছাড়া গর্ভাবস্থায় কোনো নারী হেপাটাইটিস ই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে মা ও গর্ভস্থিত শিশু জটিল সমস্যায় পড়তে পারে। এমনকি মা ও শিশুর মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

বর্ষায় বাড়ে ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রকোপ

আক্রান্ত হলে কী করবেন

হেপাটাইটিস এ ও ই-এর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা নেই। মূলত উপসর্গ দেখে উপসর্গগত চিকিৎসা দেওয়া হয়। নিয়ম মেনে চললে আক্রান্ত রোগী ঘরেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারেন। পর্যাপ্ত পানি পান, ঘন ঘন স্যালাইন খাওয়া ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। তবে পরিস্থিতি খারাপের দিকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

প্রতিরোধে পরামর্শ

  • স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
  • নিরাপদ পানীয় জল এবং বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন।
  • হেপাটাইটিস ‘ই’-এর টিকা নেই; কিন্তু ‘এ’-এর আছে। এটি নিয়ে রাখতে পারেন।

অধ্যাপক ডা. মিয়া মাশহুদ আহমদ

অধ্যাপক ডা. মিয়া মাশহুদ আহমদ

এমবিবিএস, এমডি, পিএইচডি, এফআরসিপি (এডিন)
অধ্যাপক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ
মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল
প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp