বর্ষায় শিশুদের ডায়রিয়া
বর্ষাকালে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ বেড়ে যায়। বিশেষ করে, এ সময় অনেকে নানা রকম পেটের অসুখে ভুগে থাকেন। এগুলোর মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হারই বেশি। যেকোনো বয়সের মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শিশুদের এতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
গ্রাম বা শহরবাসী—ঝুঁকিতে সবাই
প্রতি বছর বন্যার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ডুবে যায় নদী-নালা, খাল-বিল। টিউবয়েলসহ নিরাপদ পানির উৎসগুলোও তলিয়ে যায়। ফলে দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির সংকট। বর্ষাকালে শহরাঞ্চলেও এই সমস্যা তৈরি হয়। বৃষ্টির পানি ড্রেনের নোংরা পানির সঙ্গে মিশে যায়। রাস্তাঘাটে, লোকালয়ে উঠে আসে নোংরা পানি। বিশেষত কাঁচাবাজারগুলো দূষিত পানির সংস্পর্শে আসে বেশি। মাছ-মাংস, শাক-সবজি বা ফলমূল দূষিত পানির সংস্পর্শে এসে আরো বেশি অনিরাপদ হয়ে ওঠে। এসব খাবার বাসায় এনে বিশুদ্ধ না করে খেলে পেটের সমস্যা হয়ে থাকে।

শিশুদের ডায়রিয়ার ঝুঁকি বেশি
বর্ষায় শিশুদের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। মূলত হেপাটাইটিস এ, রোটা ভাইরাস, কলেরা, স্যালমোনেলা—এসব জীবাণু শিশুর ডায়রিয়ার জন্য দায়ী। আর বর্ষাকাল এসব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়।
ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া
হেপাটাইটিস এ : দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। এটি যকৃৎকে সংক্রমণ করে। মূলত শিশুরাই এতে আক্রান্ত হয়। এতে জ্বর, বমিভাব, বমি, শারীরিক দুর্বলতা ও পেটব্যথাসহ নানাবিধ জটিলতা হয়।
রোটা ভাইরাস : ভাইরাসটি সাধারণত নবজাতক শিশুদের আক্রমণ করে। প্রথমে শিশুর পরিপাকতন্ত্র আক্রান্ত হয় এবং পরে ডায়রিয়ায় রূপ নেয়।
অ্যাডিনো ভাইরাস : শিশুদের ক্ষেত্রে এতে সংক্রমিত হওয়ার হার বেশি। জ্বর-সর্দি-কাশি এর মূল লক্ষণ। তবে এতে সংক্রমিত শিশুর ডায়রিয়ার মতো পেটের সমস্যাও হতে পারে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত ডায়রিয়া
স্যালমোনেলা : খাবার ও পানির মাধ্যমে এটি ছড়ায়। সাধারণত সালাদ, রান্না না করা খাবার ও দুগ্ধজাতীয় খাবারে এর উপস্থিতি বেশি থাকে। যেসব শিশুরা মুখে আঙুল দেয় তাদের ক্ষেত্রে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
ই-কোলাই : এটি অন্ত্রের ভেতর প্রাকৃতিকভাবেই থাকে। পানি বা খাদ্যদূষণের কারণে এর দ্বারা পেট সংক্রমিত হতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়ার লক্ষণ
সাধারণত শিশুরা এমনিতেই ঘন ঘন পায়খানা করে থাকে। তাই বারবার মলত্যাগ মানেই ডায়রিয়া—এমনটা ভাবার কারণ নেই। তবে শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে ঘন ঘন মলত্যাগের পাশাপাশি নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিয়ে থাকে।

- পানির মতো পাতলা মলত্যাগ।
- স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে মল বেশি দুর্গন্ধযুক্ত।
- পেটে প্রচণ্ড ব্যথার সঙ্গে পেট কামড়ানো।
- মলের সঙ্গে রক্ত আসতে পারে।
- বমি হতে পারে।
- হজমক্ষমতা কমে যায়।
- খাবারে অনীহা দেখা দেয়।
- প্রস্রাবের বেগ কমে যেতে পারে।
- কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।
- শিশুর ওজন কমে যেতে থাকে।
- শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং মাত্রাতিরিক্ত কান্নাকাটি করে।
শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে যা করবেন
এ সময় শিশুর যত্নআত্তির ব্যাপারে খুব সচেতন থাকা জরুরি। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে কোনোভাবেই যেন শিশু পানিশূন্যতায় না ভোগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হলে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
- শিশু যদি স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডাবের পানি, স্যালাইন, ভাতের মাড় প্রভৃতি খাওয়ানো যেতে পারে।
- পাকা কলা খাওয়ালেও উপকার পাওয়া যাবে।
- চাল, মুরগি, কাঁচকলা দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করে খাওয়াতে পারেন।
- পেটে গ্যাসের সমস্যা বা অ্যালার্জির উদ্রেক করে এমন খাবার, যেমন—গরুর দুধ, বিস্কুট, ভাজাপোড়া প্রভৃতি খাওয়াবেন না।
- প্রোবায়োটিক (টকদই, পনির, কলা প্রভৃতি) খাওয়ানো যেতে পারে।
কখন নেবেন হাসপাতালে
একটু অসতর্কতা শিশুর জন্য বড়ো ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে আক্রান্ত শিশুকে অবশ্যই নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন।
- মলের সঙ্গে রক্ত এলে
- বারবার বমি হলে
- ৫—৬ ঘণ্টা প্রস্রাব না হলে
- সারাদিনে জ্বর না কমলে
- পেট ফুলে গেলে

ডা. আজমেরী সুলতানা চৌধুরী
এমবিবিএস, এফসিপিএস (শিশুরোগ)
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
জুনিয়র কনসালট্যান্ট
ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিক্স অ্যান্ড নিউনেটোলজি
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল