বোনম্যারো প্রতিস্থাপন

বোনম্যারো প্রতিস্থাপন

জন্মগত থ্যালাসেমিয়া নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে রফিক ও ঝুমুর প্রথম সন্তান রূম্পা। থ্যালাসেমিয়ার কথা শুনে সন্তান আগমনের সমস্ত আনন্দ যেন এক নিমেষেই ছাই হয়ে যায় এই দম্পতির। চিকিৎসকগণ তাদের অভয় দেন। জানান, বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য নিরাময়যোগ্য একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। শুরু হয় এই সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।

বোনম্যারো প্রতিস্থাপন ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়াসহ নানা ধরনের রক্তরোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি।

ব্লাড ক্যানসার বা লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা, মায়োলোমা, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া এই রোগগুলোর কথা শুনলেই সাধারণ মানুষ ভড়কে যান। বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই এই রোগগুলো থেকে বেঁচে ফেরা সম্ভব। কোনো যাদুমন্ত্রবলে নয়, বোনম্যারো প্রতিস্থাপন চিকিৎসার মাধ্যমেই রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব।

বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কী?

শরীরের হাড়ের ভেতরে একধরনের নরম পদার্থ থাকে, যাকে ম্যারো বা মজ্জা বলে। হাড়ের এই মজ্জা বোনম্যারো নামে সর্বাধিক পরিচিত। কোনো কারণে বোনম্যারো ক্ষতিগ্রস্থ হলে এর প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কিডনি বা হার্টের মতো অঙ্গ প্রতিস্থাপন নয়। বোনম্যারো প্রতিস্থাপন সাধারণত দুই ধরনের। অটোলোগাস ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট। প্রথমটিতে রোগীর শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে বসানো হয়। দ্বিতীয়টিতে অন্যের শরীর থেকে সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে বসানো হয়। স্টেমসেল একধরনের মাদার সেল যা বোনম্যারোতে থাকে এবং এখান থেকে সব ধরনের রক্তকণিকা তৈরি হয়। এটি দুইভাবে সংগ্রহ করা যায়- রক্ত থেকে এবং বোনম্যারো থেকে।

বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের আগে রোগী বা ডোনারকে গ্রোথ ফ্যাক্টর ইনজেকশন দেওয়া হয়। এই ইনজেকশন বোনম্যারোকে স্টিমুলেট করে স্টেম সেলকে রক্তের মধ্যে নিয়ে আসে। তারপর সেটি সংগ্রহ করে প্রসেস এবং সংরক্ষণ করা হয়। তারপর শিরার মাধ্যমে রোগীর রক্তে এই স্টেম সেল প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর স্টেম সেল নিজে নিজেই রক্তের মাধ্যমে রোগীর অস্থিমজ্জায় পৌঁছে যায় এবং ধীরে ধীরে এই সেল লোহিত রক্তকণিকা ও শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় এনগ্র্যাফট। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে অন্তত দুই-চার সপ্তাহ সময় লাগে এবং রোগীকে নিয়মিত চেক-আপের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ এ সময় ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং রোগী অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় থাকে। তাদেরকে একটি বিশেষ কক্ষে (HEPA) রাখা হয়, যেখানে ক্লিন এয়ারের ব্যবস্থা থাকে।

কেন প্রয়োজন বোনম্যারো প্রতিস্থাপন?

আমাদের দেহের রক্তকণিকাগুলোর বিশেষ কাজ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই রক্তকণিকাগুলো বোনম্যারোতে উৎপন্ন হয়ে থাকে। যদি কোনো কারণে রক্তকণিকা উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে বা সঠিক মাত্রায় উৎপন্ন না হয়, তাহলে রক্তশূন্যতা, রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে। এমনকি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে প্রদাহ দেখা দিতে পারে। এই অবস্থা চলতে থাকলে রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারেন। ব্লাড ক্যানসারসহ বিভিন্ন রক্তরোগের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে সাময়িক সমাধান হলেও পূর্ণ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এসব ক্ষেত্রে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন একমাত্র সম্ভাবনাময় চিকিৎসা।

কোন কোন রোগে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন?

বোনম্যারো প্রতিস্থাপন একধরনের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা। অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো এই চিকিৎসায় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। বিভিন্ন ধরনের রক্তরোগের চিকিৎসায় বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন—

  • ব্লাড ক্যানসার (অ্যাকিউট ও ক্রনিক লিউকেমিয়া)
  • অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া (রক্ত উৎপাদন না হওয়া)
  • লিম্ফোমা (লসিকা গ্রন্থি বা লিম্ফোসাইটের ক্যানসার)
  • থ্যালাসেমিয়া মেজর
  • মাল্টিপল মাইলোমা বা প্লাজমা সেলের ক্যানসার
  • মাইলোডিপ্লাস্টিক সিনড্রোম বা অস্বাভাবিকভাবে রক্তকণিকা তৈরি
  • মাইলোফাইব্রোসিস বা বোনম্যারোতে ফাইব্রাস
  • টিস্যু বেড়ে যাওয়া
  • ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম
  • নিউরো ব্লাসটোমা, জার্মসেল টিউমার

বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের পর বিবেচ্য বিষয়

বোনম্যারো প্রতিস্থাপন ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়াসহ নানা ধরনের রক্তরোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। উপযুক্ত ডোনার পাওয়া গেলে এবং প্রতিস্থাপনপরবর্তী জটিলতাগুলো সামলে নিলে বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রোগীর ৯০ শতাংশ পর্যন্ত নিরাময় সম্ভব। সারাজীবন ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মতো জটিল ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার চেয়ে একবারে বোনম্যারো প্রতিস্থাপনই শ্রেয়। বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের পর বেশকিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা জটিলতা দেখা দিতে পারে—

  • প্রতিস্থাপনের পর গ্র্যাফট ভার্সেস হোস্ট ডিজিজ (GVHD) জনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এছাড়া গ্র্যাফট ফেইলর বা রিজেকশন হতে পারে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত।
  • ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাকজনিত প্রদাহ হতে পারে। নিউমোসিস্টিস কারিনি প্রদাহ প্রতিস্থাপনের পর জীবননাশের কারণ হতে পারে।
  • প্রতিস্থাপনের পর বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।
  • সেকেন্ড ম্যালিগন্যান্সি, চোখের ছানি, অ্যান্ডোক্রাইন জটিলতাও হতে পারে।
  • অ্যালোজেনিক প্রতিস্থাপন হলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। তবে, সফলতা নির্ভর করে পরিবেশ, ট্রান্সপ্ল্যান্ট টিমের দক্ষতা এবং সঠিক রোগী ও ডোনার নির্বাচনের ওপর।
  • অ্যালোজেনিক বোনম্যারো প্রতিস্থাপনে সম্পূর্ণ ম্যাচ ডোনার না পাওয়াটা একটি বড়ো ধরনের অন্তরায়। কারণ আমাদের দেশে আজকাল ছোটো পরিবার এবং কোনো স্টেমসেল ডোনার রেজিস্ট্রি নেই। বিদেশের মতো আমাদের দেশেও একটি বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ প্রয়োজন।

ডা. এম. এ. খান

অধ্যাপক, ডা. এম. এ. খান

এফসিপিএস (হেমাটোলজি), এফআরসিপি (এডিন)
রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিজিশিয়ান
প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা
হেমাটোলজি ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp