ব্যথা নিয়ে বিভ্রান্তি

-অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা

ব্যথা নিয়ে বিভ্রান্তি

বুকে ব্যথা হলে প্রথমেই আমরা কী চিন্তা করি? হয়তো অ্যাসিডিটি হয়েছে, একটা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কখনো এটা ভাবি না, হতে পারে হৃদরোগের ব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্ট। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথাও তো হতে পারে। আবার কেউ কেউ সামান্য মাথাব্যথা হলেও অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এক মাথাব্যথারই আছে নানান ধরন। মাইগ্রেন, সাইনোসাইটিস, টেনশন টাইপ হেডেক, ক্লাস্টার হেডেক, আঘাতজনিত ব্যথা ইত্যাদি।

শরীরের নানান ধরনের ব্যথায় প্রায়ই অনেকে এমন বিভ্রান্তিতে পড়েন। ব্যথার কারণ না জেনে নিজে নিজে ওষুধ সেবন করেন। ব্যথা নিয়ে এসব বিভ্রান্তি ও অবহেলা কখনো কখনো রোগীকে জটিল অবস্থায় ফেলে দেয়। পরিচিত কিছু ব্যথা ও সেসব ব্যথা নিয়ে যত বিভ্রান্তি প্রচলিত তা নিম্নরূপ

বুকে ব্যথা- হৃদরোগ নাকি গ্যাস্ট্রিক

হৃদরোগের ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন অনেকেই। ব্যথার ধরনে কখনো কখনো মিল পাওয়া গেলেও দুটো জিনিস পুরোপুরি ভিন্ন। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে রোগীর জীবন সংশয় হতে পারে। হৃদরোগের অন্যতম উপসর্গ বুকের একপাশে বা বুকজুড়ে চাপ চাপ ব্যথা। হাত বা শরীরের কোনো অংশে ব্যথা হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক হলে ব্যথার সঙ্গে প্রচণ্ড ঘাম হওয়া ও কথা জড়িয়ে আসার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। বুক ধড়ফড় করা ও অনেকসময় মুখের একপাশ বেঁকে যেতে দেখা যায়। আবার কখনোই বুকে ব্যথা হয়নি, বুকে চাপ ধরে আসেনি, এমনকি কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায়নি তারপরও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাই বুকে ব্যথা হলে গ্যাস্ট্রিক ভেবে অবহেলা করবেন না। ব্যথা শুরু হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিন।

প্রস্রাবের সময় ব্যথা- ইনফেকশন নাকি কিডনি রোগ

প্রস্রাবে ব্যথা কিডনি রোগের প্রধানতম লক্ষণ। তবে, শুধু কিডনির সমস্যা হলেই প্রস্রাবে ব্যথা হবে এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ডায়াবেটিস, টিউমার, মূত্রথলির সমস্যা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, পুরুষদের প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড বড়ো হয়ে যাওয়া, মহিলাদের জরায়ুমুখের প্রদাহসহ নানান কারণে কিডনির ছাঁকনিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রস্রাবে ব্যথা ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার প্রস্রাবের ইনফেকশন হলেও ব্যথা হতে পারে।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও কর্মক্ষম মানুষের প্রতিদিন দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করা জরুরি। অনেকেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পানি পান করেন। এ কারণেও প্রস্রাবে ব্যথা হতে পারে। একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন চার-পাঁচবার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক। যদি এর চেয়ে বেশি বা কম হয় এবং এটি নিয়মিত হতে থাকে, তাহলে দ্রুত একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন।

পেটে ব্যথা হলেই কি পিত্তে পাথর

বেশিরভাগ সময়ই পেটব্যথাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এই পেটব্যথা হতে পারে জটিল কোনো অসুখের উপসর্গ। অথবা নিতান্তই গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। আসলেই ব্যথাটা কোন রোগের সেই কারণটা জানা সবচেয়ে জরুরি।

গ্যাস্ট্রিক বা পেপটিক আলসারের ব্যথা সাধারণত পেটের ওপরের দিকে মাঝখানে শুরু হয়। ব্যথার সঙ্গে বমিভাব, টক ঢেঁকুর, পেটফাঁপা ইত্যাদি সমস্যা থাকতে পারে। আবার একই জায়গায় বা খানিকটা বাঁ দিক ঘেঁষে তীব্র ব্যথা হলে সেটি গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা নয়। এটি অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহের কারণে হতে পারে।

পিত্তথলির ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের ব্যথার মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। অনেকসময় বুঝে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে। পেটের ওপরে ডান দিকে বা মাঝে ব্যথা হলে সেটি পিত্তথলিতে প্রদাহ বা পাথরের কারণে হতে পারে। ব্যথার সঙ্গে বমি হতে পারে। তাই পেটে ব্যথা হলে অবহেলা করবেন না।

মাথাব্যথা মানেই মাথার অসুখ নয়

ব্যথা নিয়ে বিভ্রান্তি

মাথাব্যথা হলে অনেকেই মাথার কোনো অসুখ ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। মাথাব্যথা সবসময় মাথার অসুখের কারণে হবে এটি পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাথাব্যথার বড়ো কারণ স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা। এছাড়া নানান কারণেই মাথাব্যথা হতে পারে। অনেকসময় নতুন চশমা ব্যবহার করলে মাথাব্যথা হয়। মেয়েদের ঋতুস্রাব ও হরমোনের তারতম্যজনিত কারণে মাথাব্যথা হতে পারে।

অতিরিক্ত ও নিয়মিত মাথাব্যথা হলে ভাবনার প্রয়োজন আছে। মাইগ্রেন, সাইনোসাইটিস, মস্তিষ্কের টিউমারসহ জটিল কারণেও মাথাব্যথা হয়ে থাকে। তাই মাথাব্যথা হলে দুশ্চিন্তা না করে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

পায়ে ব্যথা- ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি নাকি আর্থ্রাইটিস

আমিষজাতীয় খাবার ও কোষের বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের দেহে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। আবার কিডনি থেকে প্রস্রাবের মাধ্যমে এই অ্যাসিড শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। কোনো কারণে এটি যখন শরীর থেকে বের হতে পারে না তখন পায়ের হাড়ের সন্ধিতে জমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে অস্থিসন্ধি ফুলে প্রদাহ দেখা দেয়। পায়ে ব্যথা শুরু হয়। তবে পায়ে ব্যথার জন্য সবসময় ইউরিক অ্যাসিডই দায়ী তা বলা যায় না। হতে পারে সেটি আর্থ্রাইটিস বা অস্টিওপোরোসিসের কারণে। বয়সের কারণে হাড়ক্ষয় হয়।
এই ক্ষয়ের কারণেও ব্যথা হতে পারে। আবার অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম আবহাওয়ায় অবস্থান করার ফলে কিংবা দেহে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিলে ব্যথা হতে পারে। পায়ে ব্যথা হলে অনেকেই বুঝতে পারেন না কী করবেন। বিভিন্ন কারণেই পায়ে ব্যথা হতে পারে। সেটি কখনো জটিল রোগের কারণে আবার কখনো আঘাত বা অন্য কোনো কারণে। তাই ব্যথার চিকিৎসা শুরু করার আগে ব্যথার কারণ জানুন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ব্যথা নিয়ে বিভ্রান্তি

অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা

অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা

এমবিবিএস, পিএইচডি (মেডিসিন)
এফএসিপি, এফআরসিপি (এডিন)
অনারারি প্রফেসর, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp