ব্রেস্ট ক্যানসার সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি জানি। কেউ ভয় নিয়ে জানি যে, ক্যানসার হলেই বুঝি মারা যাব। কেউ ভাবে ক্যানসার হলেই অনেক টাকা খরচ। কেউ ভাবি, ব্রেস্ট ক্যানসার হলে ব্রেস্ট ফেলে দিলেই বোধ হয় বেশিদিন বাঁচা যাবে।
স্ক্রিনিং হলো কোনোরকম সমস্যা বা লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যেন একেবারে শুরুতেই রোগটি শনাক্ত করতে পারি এবং চিকিৎসা শুরু করতে পারি। প্রতি আটজনে একজনের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা ক্যানসারের ঝুঁকিগুলো থেকে দূরে থাকব এবং যেকোনো সমস্যায় চিকিৎসকের কাছে যাব। কিন্তু যেহেতু কোনো সমস্যা না থাকলেও ১২ শতাংশ ঝুঁকি থাকে ক্যানসার হওয়ার, তাই ৩৫ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি দু’বছর পরপর মেমোগ্রাম করানো হলো স্ক্রিনিং। উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত সরকারি ব্যবস্থাপনায় জনগণের নিয়মিত চেকআপ করানো হয়। যেহেতু আমাদের দেশে সরকারি পর্যায়ে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু নেই তাই জনগণও ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামায় না।
কারা করাবেন
৩৫ বছর বয়সের পর প্রতি দু’বছর অন্তর মেমোগ্রাম করে স্ক্রিনিং করাবেন। যাদের পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তারা এ ব্যাপারে অধিক সচেতন থাকবেন।
কোথায় করাবেন
দেশে বেশকিছু স্ক্রিনিং সেন্টার আছে। অথবা ব্রেস্ট সার্জনদের কাছেই স্ক্রিনিং করাতে পারেন।
স্ক্রিনিং করালে কি ক্যানসার হবে না
লক্ষণ প্রকাশ পেতে পেতে অনেক সময় রোগটি মারাত্মক আকার ধারণ করে ফেলে। শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর চিকিৎসা করালে রোগীর আদতে খুব একটা লাভ হয় না। যদিও স্ক্রিনিং করালেও ক্যানসার যার হবার তার হবেই। তবে যদি নিয়িমিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে খুব প্রাথমিক অবস্থাতেই রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা যায় তাহলে তার সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা
ক্যানসার হলে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি প্রভৃতির সমন্বয়ে একটি সমন্বিত চিকিৎসার দরকার হয়।
চিকিৎসাপদ্ধতিগুলো কোন রোগীর জন্য কতটুকু প্রয়োগ করতে হবে তা সিদ্ধান্ত নেন সার্জন, মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, প্যাথোলজিস্ট, রেডিওলজিস্টগণ। এই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়াকে বলে মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম ম্যানেজমেন্ট।
নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের সুবিধাসমূহ
ভাবুন, যখন ক্যানসারটি শনাক্ত হচ্ছে তখন এটি ৩-৫ সেন্টিমিটার হয়ে যায় এবং অনেক সময় বগলের নিচের গ্ল্যান্ডেও চলে যায়। বগলের নিচে গেলে অপারেশনের সময় দশটির ওপরে গ্ল্যান্ড ফেলতে হয়। যার ফলে পরবর্তীকালে হাত ফুলে যায়। রোগীর নিজের কাজ করতেও অসুবিধা হয়। ক্যানসারের ধরন ভালো না হলেও বগলে না গেলে কেমোথেরাপি দেওয়া লাগে না। কিন্তু যদি বগলে যায় তবে কেমোথেরেপি দিতে হয়। অনেক সময় রেডিওথেরাপিও দেওয়া লাগে। এতে চিকিৎসা-খরচ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থাতে অর্থাৎ ছোটো অবস্থাতেই ধরা পড়লে ব্রেস্ট রেখেই ক্যানসার অপারেশন করা সম্ভব। স্টেজ ০ তে ধরা পড়লে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ। অপরদিকে স্টেজ ৩ তে ৪০ শতাংশ। বিশ্বের ২৬টি দেশে সরকারি পর্যায়ে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু আছে। তবে আমাদের দেশের অনেক সামর্থ্যবান মানুষও শুধু জানার অভাবে এটুকু করে না এবং পরবর্তীকালে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখিন হয়।
বাংলাদেশের প্রতি ১০০টি ক্যানসারের মধ্যে ২৩ টি ব্রেস্ট ক্যানসার, ২১টি সারভাইক্যাল ক্যানসার, বাকি ৫৬টি অন্যান্য ক্যানসার।
বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে যতদিন স্ক্রিনিং না হচ্ছে, ততদিন আমাদের নিজ দায়িত্বে স্ক্রিনিং করাতে হবে। বাংলাদেশে ব্রিটিশ অনকোপ্লাস্টিক সার্জনের তত্ত্বাবধানে ইংল্যান্ডের প্রটোকল অনুযায়ী ব্রেস্টের সকল চিকিৎসা করানো হচ্ছে। আপনাদের দায়িত্ব সময়মতো স্ক্রিনিং করানো। আমরা মেনিকিউর পেডিকিওর করি, ফেসিয়াল করি, ভালো জামা পরি, কিন্তু অসুস্থতা যতক্ষণ পর্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ না করে ততক্ষণ সেদিকে দৃষ্টিপাত করি না। অথচ নিয়মিত ব্রেস্ট স্ক্রিনিং করালে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি যেমন হ্রাস পায় তেমনি ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও সময়মতো সঠিক চিকিৎসায় রোগী সুস্থ্ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
ডা. আলী নাফিসা
এমবিবিএস, এফসিপিএস (সার্জারি)
প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক (একেএমসিএইচ)
কনসালট্যান্ট, অনকোপ্লাস্টিক ব্রেস্ট সার্জারি
ল্যাবএইড ক্যানসার হসপিটাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার