বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন শারীরিক ক্ষমতার পরিবর্তন আসে, তেমনি পরিবর্তন আসে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিচাহিদার। খাবারের রুচির পরিবর্তন হলেও এসময় বেড়ে যায় ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেল, তরল ও কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা। এসব চাহিদা মেটাতে যেমন পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন তেমনি মাথায় রাখা প্রয়োজন খাবারটি যেন সহজপাচ্য হয়। এসময় অনেক খাবারই পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পরিবর্তে শারীরিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই পরিবারের বয়স্ক মানুষটি কী ধরনের খাবার খাবেন আর কী ধরনের খাবার খাবেন না সেদিকে বাড়তি নজর রাখা প্রয়োজন।
কী খাবেন, কী খাবেন না
পর্যাপ্ত প্রোটিন: বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন কমতে থাকে পেশির ক্ষমতা। পেশির ক্ষমতা লোপ পাওয়ার এই ব্যাপারটিকে বলা হয় সারকোপেনিয়া। হাড়ক্ষয়, সহজে হাড় ভেঙ্গে যাওয়া কিংবা ভাঙ্গা হাড় জোড়া না লাগা ইত্যাদির পেছনে অনেকাংশেই দায়ী এই সারকোপেনিয়া। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পর্যাপ্ত প্রোটিন প্রয়োজন। এজন্য ডাল, ডিম, মটরশুঁটি, বাদাম, বীজ, মাশরুম, মুরগি, মাছ ও চর্বি ছাড়া মাংস রাখতে হবে প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায়।
আঁশযুক্ত খাবার: চলাফেরা কমে যাওয়া, অন্য কোনো অসুখ ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ বিভিন্ন কারণে বয়স্কদের প্রায়শই কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতে দেখা যায়। বিশেষ করে ৬৫ বছরের বেশি বয়সে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে ও অন্ত্রের গতিবিধি ঠিক রাখতে পরিবারের বয়স্ক মানুষটির খাদ্যতালিকায় আঁশযুক্ত খাবার রাখা আবশ্যক। লাল আটার রুটি, শাকসবজি ও খোসাসহ ফলমূল ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
ক্যালরি কম পুষ্টি বেশি: পরিবারের বয়স্ক মানুষটি যেন অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার না খান সেটি খেয়াল রাখতে হবে। তবে সেই সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে ক্যালরির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেন শরীরে পুষ্টিঘাটতি দেখা না দেয়। তাই এ সময় ভাত, আলু, মিষ্টিজাতীয় খাবার কমিয়ে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ ইত্যাদির পরিমাণ বাড়াতে হবে।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন- হাড়ক্ষয় হতে থাকে তেমনি কমে যেতে থাকে নতুন হাড় তৈরির ক্ষমতা। এ থেকে সহজে হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার পাশাপাশি ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগতে বেশ সময় লেগে যায়। বেড়ে যায় অস্টিওপোরোসিস ও আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি। এসব থেকে বাঁচতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম। ভিটামিন ডি-র সবচেয়ে বড়ো উৎস হলো সূর্যের আলো। আর ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে খেতে হবে দুধ, দই, পনির, ডিমের কুসুম, তিল, মাশরুম, ফলের রস, কাঁটাসহ মাছ, বিভিন্ন ধরনের শাক ইত্যাদি।
মিষ্টি জাতীয় খাবারে সতর্কতা: বয়স্ক মানুষদের শরীরে এমনিতেই নানা অসুখ বাসা বাঁধে। আর খাদ্যাভ্যাসে একটু এদিক সেদিক হলেই শুরু হয় জটিলতা। যেমন- মিষ্টি ও চিনিযুক্ত খাবার ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এসময় মিষ্টি ও চিনিযুক্ত খাবার, যেমন- কেক, মিষ্টি, চকলেট, চা, কফি ইত্যাদি খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
পানি: বয়স্কদের শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দেওয়া খুব সাধারণ একটি সমস্যা। দীর্ঘমেয়াদি ডিহাইড্রেশনের ফলে ওষুধের শোষণক্ষমতা হ্রাস পায়, শরীর দুর্বল হয়ে যায়। তাই পানিশূন্যতা এড়াতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা আবশ্যক। এছাড়া স্যুপ, ফলের রস এগুলোও খাওয়া যেতে পারে।

ভিটামিন ডি-র সবচেয়ে বড়ো উৎস হলো সূর্যের আলো। এছাড়া ভিটামিন ডি-র ঘাটতি পূরণ করতে Labcal D ওষুধ খেতে পারেন।
অ্যান্টিফ্ল্যামেটরি খাবার: বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়েই কমতে থাকে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। ফলে বাড়তে পারে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ এবং কার্ডিওভাস্কুলার রোগ। সেই সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ তো আছেই। এ সকল জটিলতা থেকে বাঁচতে খাবারের তালিকায় রাখতে হবে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিফ্ল্যামেটরি খাবার যা শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। অ্যান্টিফ্ল্যামেটরি খাবারের মধ্যে রয়েছে টমেটো, জলপাইয়ের তেল, আখরোট, চর্বিযুক্ত মাছ, বøুবেরি, চেরি ও কমলালেবু।
লাল মাংস, ডিম কম খান: রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ঠিক রাখতে প্রোটিনের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এই প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তা উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানাবিধ রোগের কারণ হতে পারে। তাই গরু খাসি সহ যেকোনো ধরনের লালমাংস ও ডিম প্রয়োজনের অধিক না খাওয়াই ভালো।

ভিটামিন বি-১২, পটাশিয়াম ও আয়রন: ভিটামিন বি-১২, পটাশিয়াম ও আয়রন, বয়স্কদের সুস্থতার জন্য এ তিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিমের বিচি, বাদাম, কলা, মটরশুটি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-১২ আছে। বয়স্কদের নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় ভিটামিন বি-১২ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। এছাড়া উচ্চরক্তচাপ, কিডনি সমস্যা, অস্টিওপোরোসিস এবং হৃদরোগ এড়াতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পটাশিয়াম। আর পটাশিয়ামের বড়ো উৎস হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বীজ, আলু, টমেটো, খেজুর, শীতকালীন সবজি ইত্যাদি। প্রায়শই বয়স্কদের রক্তস্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আয়রনযুক্ত খাবার খাওয়া জরুরি। ডালিম, বিটরুট, শাকসবজি, ডাল, বাদাম, চর্বি ছাড়া মাংস, ডিম ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে।
খেয়াল রাখতে হবে যে, পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিটির যদি আগে থেকে কোনো শারীরিক সমস্যা থেকে থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীই খাদ্যতালিকা অনুসরণ করতে হবে।
——————————————————————————————————————————————————

সালমা পারভীন
প্রধান পুষ্টিবিদ
ল্যাবএইড হাসপাতাল